ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিগত কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন স্থাপত্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তা সে মথুরার ইদগাহ মসজিদ হোক কি বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ। সেই তালিকায় রয়েছে আগ্রার তাজমহল ও দিল্লির কুতুবমিনারও। এই আবহে জ্ঞানবাপীর সমীক্ষা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে দেশ জুড়ে। মথুরার ইদগাহ মসজিদ ও তাজমহলেরও সমীক্ষার দাবি উঠেছিল। একই দাবি ওঠে কুতুবমুনারকে ঘিরে।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দক্ষিণ দিল্লির অন্যতম আকর্ষণ কুতুবমিনার। কুতুবুদ্দিন আইবকের নির্দেশে তৈরি এই মিনার এবার বিতর্কের কেন্দ্রে। সম্প্রতি কিছু সংবাদে প্রকাশিত হয়, কেন্দ্রীয় সরকার পুরাতত্ত্ব বিভাগকে ওই অঞ্চলে খননকাজের নির্দেশ দিয়েছে। সেখানে মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে কি না, তা দেখার জন্য ওই নির্দেশ বলে জানানো হয়।
যদিও রোববার কেন্দ্রীয় সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জি কে রেড্ডি জানিয়েছেন, এমন কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টগুলি ভিত্তিহীন। কিন্তু তাতেই বিতর্ক থেমে যাচ্ছে না। কারণ, একাধিক হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী এ বিষয়ে নানাবিধ দাবি শুরু করেছে। আদালতে মামলাও দায়ের হয়েছে।
গত শনিবার সংস্কৃতিক সচিব গোবিন্দ মোহন কুতুবমিনার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তারপরেই খননকাজ নিয়ে একাধিক রিপোর্ট সামনে আসে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রুটিন তদারকির কাজেই সচিব সেখানে গিয়েছিলেন। খননকাজের কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
কিছুদিন আগে আইনজীবী হরিশংকর জৈন দিল্লি আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। জৈন দেবতা তীর্থঙ্কর ঋষভ দেবের প্রতিনিধি হিসেবে ওই মামলা দায়ের করেন তিনি। তার দাবি, কুতুবুদ্দিন আইবক মিনার তৈরির জন্য ২৭টি মন্দির আংশিকভাবে ভেঙেছিলেন। সেই ধ্বংসাবশেষ দিয়েই কুতুব কমপ্লেক্সে তৈরি হয়েছিল মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।
হরিশংকরের বক্তব্য, এখনো ওই জায়গায় দুইটি গণেশের মূর্তি আছে। পুরাতত্ত্ব বিভাগ ওই মূর্তি দুইটি ওখান থেকে সরিয়ে যাতে জাদুঘরে স্থানান্তরিত না করে, তার জন্যই ওই মামলা করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। আদালত নির্দেশ দিয়েছে, আপাতত ওই গণেশ মূর্তি সেখান থেকে সরানো যাবে না।
বিষ্ণুশংকর জৈন নামের আরেক ব্যক্তি দিল্লির সাকেত কোর্টে আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন। মূর্তিগুলিকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে ফের সেখানে পুজো করার আবেদন নিয়ে তিনি মামলা করেছেন। মঙ্গলবার সেই মামলার শুনানি হওয়ার কথা। এদিকে একটি হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর ৪৪ জন ব্যক্তি সম্প্রতি কুতুব কমপ্লেক্সে গিয়ে হনুমান চল্লিশা পড়ার চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের আটক করে।
কুতুবুদ্দিন আইবক মিনার তৈরির জন্য ২৭টি মন্দির আংশিকভাবে ভেঙেছিলেন। সেই ধ্বংসাবশেষ দিয়েই কুতুব কমপ্লেক্সে তৈরি হয়েছিল মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দাবি করেছে, কুতুবমিনারের নাম বদলে বিষ্ণু স্তম্ভ করা হোক। জৈন মন্দির ভেঙে ওই মিনার তৈরি করা হয়েছিল। সে কারণেই নাম বদলের দাবি।
কুতুবমিনার নিয়ে দিল্লি আদালতে পরবর্তী শুনানি ৯ জুন। পুরাতত্ত্ববিভাগ সেখানে পুজো করার দাবি সমর্থন করে না।মন্দির ভেঙে কুতুবমিনারে মসজিদ হয়নি, দাবি পুরাতত্ত্ব বিভাগের। মঙ্গলবার দিল্লি আদালতে এবিষয়ে শুনানি ছিল। সেখানে নিজেদের বক্তব্য স্পষ্ট করেছে পুরাতত্ত্ব বিভাগ।
মঙ্গলবার আদালতে মামলাকারীর আইনজীবী বলেন, যেহেতু সেখানে মন্দির ছিল, তাই ওই চত্বরে পুজো করার অনুমতি দেওয়া হোক। অন্যদিকে, পুরাতত্ত্ব বিভাগ দাবি করে, কুতুবমিনার চত্বরে যে মসজিদ আছে, তা মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছে এমন নিদর্শন নেই।
তাদের আরও দাবি, ১৯১৪ সাল থেকে কুতুবমিনার একটি সংরক্ষিত সৌধ। সেখানে কখনোই কোনো ধর্মের মানুষ প্রার্থনার আয়োজন করেনি। সেই অবস্থান থেকে সরা যাবে না। ফলে সেখানে পুজো করার দাবির বিরোধী তারা। আদালত জানিয়েছে, আগামী ৯ জুন এবিষয়ে তারা নির্দেশ দিতে পারে। অন্যদিকে, এদিনই বারাণসী আদালতের জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ক নিয়ে রায় দেওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু আদালত জানিয়েছে, আগামী ২৬ মে পরবর্তী শুনানি হবে। এদিন তারা রায় দেওয়া থেকে বিরত থাকে। আদালত দুই পক্ষের কাছ থেকেই সমীক্ষা রিপোর্টের উপর মতামত জানতে চেয়েছে।
ঐতিহাসিক স্থাপত্যের দিক দিয়ে ভারত উপমহাদেশ অনন্য অবস্থানে। বিভিন্ন দেশে প্রদেশে, জনপদে জনপথে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেইসব অনিন্দ্য স্থাপত্য নিদর্শন। আলোচিত সেইসব স্থাপত্যের অন্যতম ভারতের কুতুব মিনার।
কুতুব মিনার ভারতের দিল্লীতে অবস্থিত একটি স্তম্ভ বা মিনার, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার। এটি কুতুব কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত, প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাথর দিয়ে কুতুব কমপ্লেক্স এবং মিনারটি তৈরি করা হয়েছে। লাল বেলেপাথরে নিৰ্মিত এই মিনারটির উচ্চতা ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফুট)। মিনারটির পাদদেশের ব্যাস ১৪.৩২ মিটার (৪৭ ফুট) এবং শীৰ্ষঅংশের ব্যাস ২.৭৫ মিটার (৯ ফুট)। ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর প্ৰথম দিকে এই মিনারের নিৰ্মাণকাৰ্য সমাপ্ত হয়। মিনার প্ৰাঙ্গনে আলাই দরজা (১৩১১), আলাই মিনার (এটি অসমাপ্ত মিনারের স্তূপ, এটা নিৰ্মাণের কথা থাকলেও, নিৰ্মাণকাৰ্য সমাপ্ত হয়নি), কুওয়ত-উল-ইসলাম মসজিদ (ভারতের প্ৰাচীনতম মসজিদসমূহের অন্যতম, যেসব বৰ্তমানে আছে), ইলতুতমিসের সমাধি এবং একটি লৌহস্তম্ভ আছে।
আফগানিস্তানের জাম মিনার এর অনুকরণে এটি নির্মিত হয়। পাঁচ তলা বিশিষ্ট মিনারের প্রতিটি তলায় রয়েছে ব্যালকনি বা ঝুলন্ত বারান্দা। কুতুব মিনারের নামকরণের পেছনে দুটি অভিমত রয়েছে, প্রথমত এর নির্মাতা কুতুব উদ্দিন আইবেকের নামানুসারে এর নামকরণ। দ্বিতীয়ত ট্রান্সঅক্সিয়ানা হতে আগত বিখ্যাত সুফী সাধক হযরত কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর সম্মানার্থে এটি নির্মিত হয়।
কুতুব মিনার বিভিন্ন নলাকার শ্যাফট দিয়ে গঠিত যা বারান্দা দ্বারা পৃথকীকৃত। মিনার লাল বেলেপাথর দিয়ে তৈরী যার আচ্ছাদন এর উপরে পবিত্র কোরআনের আয়াত খোদাই করা। ভূমিকম্প এবং বজ্রপাত এর দরুন মিনার এর কিছু ক্ষতি হয় কিন্তু সেটি পুণরায় শাসকদের দ্বারা ঠিক করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, বলতে দ্বিধা নেই, তাদের ইতিহাসের যথেষ্ট জ্ঞান নেই। তা নিয়ে তারা যে আজগুবি কথা বলছেন, তার পিছনে আবার একটি মস্ত চক্রান্ত রয়েছে। গৈরিক ঐতিহাসিকরা ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় নতুন ব্যাখ্যার আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে সেই বিতর্ক হলে তর্ক করতে অসুবিধা নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কিন্তু তারা যে ইতিহাস বলছেন, তা বিতর্কেরও অযোগ্য।
তারা বলেন, তারা আসলে ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। তাদের রাজনীতিটা হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি। তাই অতীতের অ-হিন্দু শাসন তাদের কাছে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সে জন্যই ইতিহাস বদলে দেয়ার চেষ্টা। এটা কট্টর মানসিকতাকে তুষ্ট করবে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে নজর অন্যদিকে ঘোরাবে। হয়তো বা ভোট পেতেও ঢালাও সাহায্য করবে। তবে বলে রাখা ভালো, এক বা একাধিক ব্যক্তি শত চেষ্টা করলেও ইতিহাস বদলাবে না। ঐতিহাসিক দলিল আগুন দিয়েও পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিন্তু সত্যকে আড়াল করা যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ