ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। হকিস্টিক, রড, চাপাতি ও দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও ছাত্রদল জানিয়েছে।
আজ মঙ্গলবার(২৪ মে) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত ৩০ নেতা-কর্মী আহত হওয়ার কথা জানিয়েছে ছাত্রদল। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করে ছাত্রদল।
ছাত্রলীগের অভিযোগ, সেই সমাবেশে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। এরপর থেকেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল ইউনিটের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে প্রতিহতের ঘোষণা দেন।
ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদকের সেই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল ছাত্রদলের।
তবে এর আগেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল ইউনিটের নেতা-কর্মীরা সকাল ৯টা থেকে মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান নেয়া শুরু করেন।
ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ঢাকা মেডিক্যাল থেকে শহীদ মিনার হয়ে টিএসসিতে যাওয়ার পথে সেখানে অবস্থান নেয়া ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হামলা চালান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত নেতা-কর্মীদের চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করছেন ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ নেতারা৷ সেখানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রাকিবুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, আমি, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আকতার হোসেন ও সদস্যসচিব আমানউল্লাহ আমানসহ পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী নিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে টিএসসির দিকে যাচ্ছিলাম৷ দুই দিন ধরে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের মহড়া দিচ্ছে বলে মিছিলে আমরা কোনো স্লোগান পর্যন্ত দিইনি৷ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান করছিলেন৷ তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলি৷ বলি যে ‘আমরা তো শান্তিপূর্ণভাবে যাচ্ছি, আমাদের অপরাধটা কী?’
‘বিনা উসকানিতে তারা হকিস্টিক, রড, চাপাতি, লাঠিসোঁটাসহ দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেন৷ হামলায় কেন্দ্রীয় নেতা রাশেদ ইকবাল খান, আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াসহ অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন৷’
রাকিবুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বিনা উসকানিতে তারা হকিস্টিক, রড, চাপাতি, লাঠিসোঁটাসহ দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেন৷ হামলায় কেন্দ্রীয় নেতা রাশেদ ইকবাল খান, আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াসহ অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন৷’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সরাসরি নির্দেশে ছাত্রদলের ওপর হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন রাকিবুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘নেতা–কর্মীরা আমাদের মানবঢাল তৈরি করে ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে আসেন৷ হামলায় গুরুতর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আরও আছেন ছাত্রদলের সেলিম মাহমুদ, এ বি এম এজাজুল কবির, সজীব মজুমদার ও ইব্রাহিম৷ ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেনের দুই হাত ভেঙে গেছে৷ নারী নেত্রীর ওপর হামলাকারী ব্যক্তিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পারে না৷ তারা বহিরাগত সন্ত্রাসী৷ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সরাসরি নির্দেশে আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অবিলম্বে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি৷’
ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আমানুল্লাহ আমান বলেন, ‘ছাত্রলীগ বলছে আমরা তাদের নেত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করেছি। কিন্তু কোন বক্তব্যে কটূক্তি করেছি সেটা তারা স্পষ্টভাবে বলতে পারছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ছাত্রদলের প্রতি সাধারণ ছাত্ররা আকৃষ্ট হচ্ছে এবং জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত হচ্ছে দেখে ঈর্শ্বান্বিত হয়ে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা করেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি অভিযোগ করে আমানুল্লাহ আমান বলেন, ‘এই পরিস্থিতি হতে পারে ধারণা করে আমি সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কয়েকজনকে অনেকবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু তারা কেউ ফোন রিসিভ করেনি। আমরা আহত হওয়ার পর আজকেও ফোন দিয়েছি কিন্তু কেউই রিসিভ করেনি।’
ছাত্রদলের ওপর এই হামলাকে ‘প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন৷ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজাকারদের তল্পিবাহক ও সন্ত্রাসের ডিস্ট্রিবিউটর ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল তাদের সহিংস সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ বিঘ্নিত করছে৷ এর ধারাবাহিকতায় দেশি অস্ত্র নিয়ে তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে৷ শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার স্বার্থে সব মতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রদলের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে৷
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ছাত্রদল। মিছিলে ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আকতার হোসেন ও সদস্যসচিব আমানউল্লাহ আমান নেতৃত্ব দেন।
ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের সামনে পৌঁছালে হলের ভেতর ও আশপাশ থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা কিছুটা পিছু হটেন; কিন্তু মিনিটখানেকের মধ্যেই তাঁরা আবার লাঠিসোঁটা হাতে সংগঠিত হয়ে ছাত্রলীগকে ধাওয়া দেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তখন পিছু হটেন। তাঁরা শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের সামনে অবস্থান নেন।
ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেন দোয়েল চত্বরে। এ সময় দুই পক্ষের মুহুর্মুহু ইট-ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে। বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে ছাত্রলীগ ছাত্রদলকে পাল্টা ধাওয়া দিলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা দৌড়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ছাত্রলীগের হয়ে এই পাল্টা ধাওয়ায় নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রীয় সাহিত্যবিষয়ক উপসম্পাদক এস এম রিয়াদ হাসানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকেরা।
এই পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর ছাত্রদল ক্যাম্পাস ছাড়লেও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের লাঠিসোঁটা হাতে দেখা গেছে।
ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় তাঁদের ১০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। আহত সব নেতা-কর্মীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেসরকারি একটি হাসপাতালে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। মাদক ব্যবসা, টেন্ডার-বাণিজ্য, পুলিশকে মারধরসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ যে আদর্শ ও নীতিতে একটি সংগঠনে রুপ নিয়েছিল সেই আদর্শ এখন আর নেই। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদর্শের চর্চা না থাকার ফলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই সর্বগ্রাসী নতুন রাজনৈতিক আদর্শ ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যাকে পারো তাকে ধরো, আওয়ামী লীগ করো নীতিতে চলতে গিয়ে ছাত্রলীগ আর আগের মতো আদর্শিক ছাত্রলীগ হতে পারছে না। তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে নেই। তারা কোনো ভাই বা সিন্ডিকেটের রাজনীতি করছে। তাদের ভাষ্যমতে, সিন্ডিকেট হলো তারাই, যারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানিয়েছে। আর ছাত্রলীগও তাদের ব্যবহার করে ধান্দার রাজনীতি করছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন চাউর হয়ে উঠছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার চূড়ান্তে বসবাস করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহবোধ না করায় তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের এই আইনের উর্ধে চলে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক নেতা কুৎসিত হাতের ভূমিকা রয়েছে। তারা বলেন, ছাত্রলীগ সংগঠনটির ছাত্রদের ধীরে ধীরে উগ্র এবং একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে রুপদানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক মদদ ও উস্কানি। এ বিষয়ে প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৩
আপনার মতামত জানানঃ