বিশ্বের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে মাঙ্কিপক্স নিয়ে দেশের বন্দরগুলোতে সতর্কতা জাতি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম স্বাক্ষর করা বিজ্ঞপ্তিতে এ সতকর্তা জারি করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি বিশ্বের ১২টি দেশে মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে জানিয়েছে। এর মধ্যে ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও সুইডেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রলিয়া এ পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের রোগী পাওয়ার কথা জানিয়েছে।
আজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থল বন্দরগুলোতে আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং স্ক্রিনিং জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আজ রোববার দেওয়া এ সতর্ক বার্তায় বলা হয়, ‘সারা বিশ্ব আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্সের রোগী শনাক্ত হয়েছে। মাঙ্কিপক্স নতুন কোনো রোগ নয়। তবে আগে এ ধরনের রোগী পশ্চিম আফ্রিকা বা মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে এন্ডেমিক হিসেবে ধরা হয়।
আগে শুধু পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ভ্রমণকারীদের বা বাসিন্দাদের মধ্যে শনাক্ত হয়েছে এ রোগ। সম্প্রতি এসব দেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই, ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাসকারী এমন ব্যক্তিদের মাধ্যে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে।’
যা বলা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেসব রোগীদের ফুসকুড়ি দেখা যায় এবং সম্প্রতি মাঙ্কিপক্সের নিশ্চিত কেস আছে এমন দেশগুলো ভ্রমণ করেছেন, অথবা এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন যাদের একই রকম ফুসকুড়ি দেখা দিয়েছে বা নিশ্চিত বা সন্দেহজনক মাঙ্কিপক্স রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন এমন রোগীদের সন্দেহজনক রোগীর তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
সন্দেহজনক এবং লক্ষ্মণযুক্ত রোগীকে কাছের হাসপাতালে বা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ বিষয়ে সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) তথ্য জানাতে হবে।
এ সতর্কবার্তা দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে হযরত শাহজালাল বিমান বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, সিলেটের সিভিল সার্জন এবং আন্তর্জাতিক বন্দর আছে এমন জেলার সিভিল সার্জনদের বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, মাঙ্কিপক্সের প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, হাড়ের জোড়া ও মাংসপেশিতে ব্যথা এবং অবসাদ। জ্বর হওয়অর পর দেহে গুটি দেখা দেয়। শুরুতে এসব গুটি দেখা দেয় মুখে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে হাত এবং পায়ের পাতাসহ দেহের অন্যান্য জায়গায়।
শাহজালাল বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাঙ্কিপক্স সংক্রান্ত নির্দেশনার চিঠিটি তারা পেয়েছেন। চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী বিমানবন্দরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি যাত্রী স্ক্যানারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ অসুস্থ বা সংক্রমিত হয়েছেন সন্দেহ হলে তাঁকে মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল রেফার করা হবে। তবে এখনো পর্যন্ত তেমন কাউকে অসুস্থ পাওয়া যায়নি।
কেন চিন্তিত বিজ্ঞানীরা?
অনেক দেশ করোনাভাইরাস মহামারির সময় আরোপ করা নানা ধরনের বিধি নিষেধ শিথিল করতে শুরু করেছে। মানুষজনের মধ্যেও যেন এক ধরনের স্বস্তির ছাপ পড়তে শুরু করেছে।
এটা পরিষ্কার যে মাংকিপক্স কোভিডের মতো নয় এবং খুব শীঘ্রই এর কারণে লকডাউন ঘোষণা হতে পারে বিষয়টা এমন না হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এর আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক।
তবে মাংকিপক্সের এই প্রাদুর্ভাব অস্বাভাবিক এবং অভূতপূর্ব। যা এই অসুখে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে তুলেছে।
যেকোনো ভাইরাসের আচরণ পরিবর্তন উদ্বেগের বিষয়। এতদিন পর্যন্ত মাংকিপক্সের আচরণ অনুমান করা সহজ ছিল। নাম শুনে বানরের কথা মনে হলেও আসছে মাংকিপক্স ভাইরাসটি পাওয়া যায় ইঁদুরের শরীরে।
ভাইরাসটির প্রাকৃতিক আবাসভূমি পশ্চিম আফ্রিকা এবং রেইনফরেস্টে বাস করে এমন কেউ হয়ত আক্রান্ত ইঁদুরের সংক্রমণে এলে অসুখটি ছড়ায়। আক্রান্তদের ত্বকে বসন্তের মতো দেখা দেয়। ফোস্কার মতো তৈরি হয়ে ফেটে যায় এবং চামড়া উঠতে থাকে। কিন্তু মাংকিপক্স এখন যেসব দেশে পাওয়া যাচ্ছে সেখানে এটি থাকার কথা নয়।
যদিও এর প্রাদুর্ভাব এখনো স্বল্প পরিসরেই রয়েছে। ভাইরাসটি খুব অল্পতেই সংক্রমিত করতে পারছে না। দীর্ঘক্ষণের সংস্পর্শ দরকার হচ্ছে।
বিশ্বে এর আগে অল্প কিছু সংক্রমণ পাওয়া গেছে তবে যাদের শরীরে এটি পাওয়া গেছে তারা সবাই ভাইরাসটির প্রাকৃতিক আবাসভূমি যেসব দেশে সেখানে ভ্রমণে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এবার যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে তাত প্রথমবারের মতো এমন সব মানুষের দেহে এটি পাওয়া গেছে যাদের সাথে পশ্চিম অথবা মধ্য আফ্রিকার কোন যোগাযোগও নেই। ফলে কিভাবে তারা আক্রান্ত হয়েছেন সেটি এখনো পরিষ্কার নয়।
প্রসঙ্গত, এবার এটি যৌন সংসর্গের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। বেশিরভাগ আক্রান্তের যৌনাঙ্গ এবং এর আশপাশে ঘায়ের মতো পাওয়া যাচ্ছে। আক্রান্তদের অনেকেই সমকামী ও উভকামী কম বয়স্ক পুরুষ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিজ্ঞান বিষয় ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক স্যার পিটার হরবি বলছেন, “আমরা খুব নতুন এক ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। যা খুব বিস্ময় এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো।”
তিনি বলছেন, আমরা দ্বিতীয় এক কোভিড মহামারিতে পড়তে যাচ্ছি ব্যাপারটা এমন না। তবে ভাইরাসটি জেঁকে বসার আগেই দ্রুত পদক্ষেপ নেবার কথা বলছেন তিনি।
মাংকিপক্স আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিয়েছেন ডা. হিউ অ্যাডলার। তিনি বলছেন, এর যে আচরণ আমরা এখন দেখছি তা আগে দেখা যায়নি। যা আশ্চর্য হওয়ার মতো।
হঠাৎ কেন ছড়াচ্ছে এই রোগ?
এখনো পর্যন্ত এটুকু জানা যাচ্ছে যে এই প্রাদুর্ভাব ব্যতিক্রমী কিন্তু কেন সেটি জানা যাচ্ছে না। দুটো বিকল্পের কথা ভাবা হচ্ছে। হতে পারে ভাইরাসটি পরিবর্তিত হয়েছে। অথবা ভাইরাসটি বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য সঠিক সময়ে উৎকৃষ্ট পরিবেশ পেয়েছে।
এমন হতে পারে যে মাংকিপক্সের জন্য ছড়ানো এখন সহজ হচ্ছে কারণ গুটি বসন্ত রোধে যে গণটিকা দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে পুরনো প্রজন্মের বসন্ত কিছুটা সুরক্ষা পাবে।
পুরনো প্রজন্মের বসন্তের সাথে মাংকিপক্সের সাদৃশ্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডা. হিউ অ্যাডলার বলেন, গুটি বসন্তের যুগের চেয়ে এটি সম্ভবত দ্রুত ছড়াচ্ছে। কিন্তু এমন কোন ইঙ্গিত নেই যে এটি ব্যাপকহারে ছড়াবে। তিনি এখনো মনে করছেন এই প্রাদুর্ভাব নিজে নিজেই শেষ হবে।
কিভাবে এই প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে সেটি জানতে পারলে পরে কি হতে যাচ্ছে সেটি অনুমান করা সহজ হবে। কার মাধ্যমে কিভাবে ছড়াচ্ছে এই বিষয়ে চিত্র এখনো পরিষ্কার নয়। বরং সংক্রমণের ঘটনাগুলো সম্পর্কিত নয় মনে হচ্ছে। এর যোগসূত্র এখনো পাওয়া যায়নি।
যদি এমন হতো যে অনেকে একসাথে কোন উৎসবে যোগ দিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, বাড়ি নিয়ে গেছেন, অন্যদের সংক্রমণ করেছেন, অন্য দেশে নিয়ে গেছেন তাহলে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা সহজ হতো।
কোন যোগাযোগ নেই এমন মানুষদের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়ানোর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে দীর্ঘদিন যাবৎ ভাইরাসটি হয়ত মানুষের মধ্যেই ছিল, ধীরে ধীরে জেঁকে বসছিল যা নজর এড়িয়ে গেছে।
আপনার মতামত জানানঃ