দেশের বাজারে এখন সয়াবিন ও পাম তেলের তীব্র সংকট চলছে। দেশে সংকট থাকলেও তেল দুটি রপ্তানিও হচ্ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ১ কোটি ৪৯ লাখ লিটার পাম ও সয়াবিন তেল রপ্তানি করেছে এ দেশের পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, যার সিংহভাগই রপ্তানি হয়েছে ভারতে।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর চার বছর ধরে রপ্তানি হচ্ছে এ দুটি ভোজ্যতেল। সয়াবিন ও পাম তেল রপ্তানি করে ১০ মাসে আয় হয়েছে ২০৭ কোটি টাকা।
তেল রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। কিন্তু দেশে সংকটের এ সময়ে রপ্তানি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ ইন্দোনেশিয়ার মতো শীর্ষ পাম তেল উৎপাদনকারী দেশ নিজেদের বাজার সামাল দিতে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
এদিকে, আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাবে দেশে রোজার আগে থেকে তেল নিয়ে সংকট শুরু হয়। এখনো এই সংকট কাটেনি।
তবে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, চলমান সংকটের সময় এ বছর কোনো তেল রপ্তানি করেনি তারা। দেশে সরবরাহেই প্রাধান্য দিয়েছে তারা। রপ্তানির যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা সংকটের আগে, গত বছরের।
প্রসঙ্গত, বছর চারেক আগেও পাম ও সয়াবিন তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০১৫-১৮ সালের রপ্তানি নীতিতে রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্য তালিকায় ১ নম্বরে ছিল সয়াবিন ও পাম তেল। দেশে চাহিদার তুলনায় পরিশোধন সক্ষমতা বেড়েছে। বীজ মাড়াই করেও সয়াবিন তেল উৎপাদিত হচ্ছে।
এরপর দুটি পণ্যকে শর্ত সাপেক্ষে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় রাখা হয়; অর্থাৎ অনুমতি নিয়েই রপ্তানি হচ্ছে সয়াবিন ও পাম তেল।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, প্রধান দুই ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন তেল সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে। গত ১০ মাসে তেলটি রপ্তানি হয় ৮৬ লাখ লিটার। আর পাম তেল রপ্তানি হয় প্রায় ৬৩ লাখ লিটার। এ থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় ২০৭ কোটি টাকা।
ভোজ্যতেলের সিংহভাগই রপ্তানি হয়েছে গত বছরের শেষ দিকে। এ বছরের প্রথম ৪ মাসে ১৫ লাখ লিটার সয়াবিন ও পাম তেল রপ্তানি হয়।
দেশ থেকে পাম ও সয়াবিন তেল রপ্তানিকারকের তালিকায় আছে টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ও দেশবন্ধু গ্রুপের এসজি অয়েল রিফাইনারি।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘আমরা এ বছর কোনো তেল রপ্তানি করিনি। সংকটের এ সময়ে তেল রপ্তানির প্রশ্নই ওঠে না। যেসব তেল রপ্তানির হিসাব দেখানো হচ্ছে, তা আগের।’
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, সয়াবিন তেলের প্রতি লিটার গড় রপ্তানি মূল্য ছিল ১৪৭ টাকা। তবে প্রতি লিটার সর্বোচ্চ ১৬০-১৬৩ টাকা দরে সয়াবিন তেল রপ্তানি হয়েছে। আর পাম তেলের গড় রপ্তানি মূল্য ছিল প্রতি লিটার ১২৯ টাকা। তবে সর্বোচ্চ ১৫৩ থেকে ১৬৪ টাকায়ও রপ্তানি হয়েছে পাম তেল।
পাম ও সয়াবিন তেল শোধিত ও অশোধিত আকারে আমদানি করে কোম্পানিগুলো। দেশে পরিশোধন করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এর বাইরে দুটি প্রতিষ্ঠান সয়াবিন বীজ ভাঙিয়ে সয়াবিন তেল উৎপাদন করে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান হলো সিটি গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপ।
কোম্পানিগুলো বলছে, দেশীয় চাহিদার চেয়ে উৎপাদনক্ষমতা অনেক বেশি। তাতে চাহিদার অতিরিক্ত সয়াবিন ও পাম তেল রপ্তানি করে তারা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি হওয়া তেলের ৯৯ শতাংশই রপ্তানি হয়েছে ভারতে। এ ছাড়া জাপানেও রপ্তানি হয়েছে দুটি চালান।
পাম তেল ও সয়াবিন তেল ছাড়াও দেশে উৎপাদিত শর্ষে ও ধানের কুঁড়ার তেলও রপ্তানি হচ্ছে। শর্ষের তেল রপ্তানি করছে প্রাণ ও স্কয়ার গ্রুপ। এ ছাড়া এসিআই ফুডস, আকিজ ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডও সামান্য পরিমাণে রপ্তানি করছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১০৪ কোটি টাকার সমমূল্যের ৫২ লাখ লিটার শর্ষের তেল রপ্তানি হয়েছে। আর ধানের কুঁড়া থেকে উৎপাদিত তেলও রপ্তানি করছে দেশীয় কয়েকটি কারখানা।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত শর্ষের তেল রপ্তানি অনেক আগে থেকেই হচ্ছে। তবে পাম ও সয়াবিন তেল রপ্তানি হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর থেকে। চার বছর ধরে রপ্তানি হচ্ছে এ দুটি তেল।
সঙ্কট ও দামবৃদ্ধি
এদিকে, বাংলাদেশে ঈদের আগে থেকে পাম অয়েল এবং সয়াবিন তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়।
ক্রেতারা অভিযোগ করে জানায়, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ভোজ্য তেল বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এবং বেশি দাম দিয়েও খুচরা বাজারে অনেক দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
খুচরা বা পাইকারি বিক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, তেল মিলগুলো বা আমদানিকারকরা বাজারে তেল সরবরাহ কমিয়ে সংকট সৃষ্টি করেছে।
রমজান শুরুর আগেও বাংলাদেশের বাজারে পাম অয়েল এবং সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে একটা সংকট তৈরি হয়েছিল। তখন সরকার হস্তক্ষেপ করে দাম নির্ধারণ করার পর সেই দফায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে।
এদিকে, বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের মূল্য রেকর্ড ভেঙ্গে লিটার প্রতি ১৯৮ টাকা ধার্য হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ব্যবসায়ীরা ঈদের আগেই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সরকার সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করায় হয়তো তেল বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ করা হয়নি।
আবার বিশ্ব বাজারে দামের উত্থান পতনের সাথে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের মনোভাব বিবেচনা করে অনেক ব্যবসায়ী আমদানির জন্য এলসি খুলতে আগ্রহী হননি।
গবেষক ডঃ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, যে দাম ঠিক করা হয়েছে সেই দামেও যেন অন্তত মানুষ তেল পায় সেটা নিশ্চিত করাই হবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
“এখানে মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল। আমদানি করা তেল যেন বাজারে থাকে এবং মানুষ যেন পায় সেটা প্রতিটি পর্যায়ে নজরদারির মাধ্যমে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে দ্রুততর সময়ে পণ্য বাজারে আনাও নিশ্চিত করতে হবে।”
যদিও ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন যে তারা মনে করছেন দাম বাড়ার কারণে এখন বাজারে এমনিতেই চাহিদা কিছুটা কমে আসবে, যা বর্তমান সংকট মোচনে ভূমিকা রাখবে।
দেশে ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুত
মার্চ মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অথচ ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিবেদেন দেখা গেছে, সমিতির সদস্য ছয় কোম্পানির কাছে বর্তমানে এক লাখ ৯৫ হাজার ৬৩৬ টন ভোজ্যতেল মজুত রয়েছে।
এর মধ্যে পরিশোধিত ভোজ্যতেল ১৯ হাজার ৭৩৭ টন এবং অপরিশোধিত ভোজ্যতেল এক লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৯ টন। আর আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৮০০ টনের।
ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মজুত তেলের মধ্যে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে সিটি গ্রুপের কাছে রয়েছে ৩৯ হাজার ৯৭৮ টন, মেঘনা গ্রুপের ৫০ হাজার, টি কে গ্রুপের ৩৭ হাজার ৪৫৯ টন, এস আলমের ৫২ হাজার ৮১৮ টন, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রয়েছে ১৫ হাজার ৩০৯ টন এবং গ্লোব এডিবল অয়েলের রয়েছে ৭২ টন।
তবে বসুন্ধরা গ্রুপসহ অন্য যেসব ভোজ্যতেল প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের কাছে কত পরিমাণ মজুত রয়েছে সেই বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে তথ্য নেই।
বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বছরে মোট ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এতে মাসে গড়ে দেড় লাখ টনের কিছু বেশি ভোজ্যতেল দরকার পড়ে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর কাছে প্রায় দুই লাখ টন মজুত রয়েছে। গত বছর আমদানি হয়েছে ২১ লাখ ৭১ হাজার টন।
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, বন্দরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল বোঝাই তিনটি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে সুমাত্রা পাম জাহাজে ১১ হাজার ৯৯৯ টন, সান জিনে ১২ হাজার টন ও পিভিটি নেপচুনে ১২ হাজার টন ভোজ্যতেল রয়েছে। বন্দর সূত্র জানায়, এক সপ্তাহের মধ্যে আরও কয়েকটি জাহাজভোজ্য তেল নিয়ে ভিড়তে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ