খুব সাধারণ একটা দিন। ভোরবেলা। রোদ উঠেছে। আর আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙছে শহরের। অনেকেই হাঁটতে বেরিয়েছে। ব্যস্ততা বাড়ছে। তবে হঠাৎ করেই বদলে গেল গোটা দৃশ্যটা। একনিমেষে কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিল আস্ত শহরটাকে। উধাও সূর্যও। তবে কি ধ্বংস হতে চলল পৃথিবী?
সেদিন অধিকাংশ মানুষই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। যদিও সেদিন ধ্বংস হয়নি ছোট্ট শহরটি। তবে সমস্ত বাসিন্দাদের মধ্যেই মৃত্যুর বীজ রোপণ করে দিয়েছিল সেই ঘটনা। বলা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর তুলারোসা শহরকে নিয়ে।
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই এমনই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল সেখানে। নিউ মেক্সিকো কেন, বিশ্বের কোনো প্রান্তের মানুষই এমন ঘটনার সাক্ষী হননি এর আগে। কিন্তু কী হয়েছিল সেদিন সকালে? কেন অন্ধকার নেমে এসেছিল দিনের বেলাতেও?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে ঘাতক যুদ্ধাস্ত্রের শিকার হয়েছিল ছোট্ট মার্কিন শহরটি। শিকার হয়েছিল পারমাণবিক বোমার নৃশংসতার। হিরোশিমা, নাগাসাকিরও সপ্তাহ তিনেক আগে এই শহর প্রত্যক্ষ করেছিল পারমাণবিকতার ঘাতক শক্তিতে।
ম্যানহাটন প্রোজেক্টের ট্রিনিটি টেস্ট সাইট থেকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটির দূরত্ব ছিল মাত্র ২৫ মাইল। ফলে, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সরাসরি আঘাত হেনেছিল তুলারোসায়। তবে এখানেই শেষ নয়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এই টেস্ট সাইটে সবমিলিয়ে প্রায় ২০০টিরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
প্রতিটি প্রোটোটাইপই বিস্ফোরিত হয়েছিল ভূপৃষ্ঠের অনেক ওপরে, শূন্যে। ফলে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং বিকিরণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা নিউ মেক্সিকো উপত্যকায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই মার্কিন প্রদেশটির তেজস্ক্রিয়তা গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোচ্চ।
স্বাভাবিকভাবে আজও এই ঘাতক যুদ্ধাস্ত্র পরীক্ষার অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন নিউ মেক্সিকোর বাসিন্দারা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে থাবা বসিয়ে আসছে ক্যানসার। শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে নিউ মেক্সিকো।
স্বাস্থ্যগত এই প্রভাবের জন্য নিউ মেক্সিকানদের পরিচয় হয়ে উঠেছে ‘ডাউনওয়ান্ডার’। তবে শুধু নিউ মেক্সিকোর সাধারণ নাগরিকরাই নয়, তেজস্ক্রিয়তার শিকার ইউরেনিয়াম খনির শ্রমিক, খনিজ পরিবহনকারী এবং তাদের পরিবারও।
সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকেই নিউক্লিয়ার ফলআউট নিয়ে সরব হন একাধিক মার্কিন সমাজসেবী। যার ফলাফল স্বরূপ ১৯৯০ সালে ‘রেডিয়েশন এক্সপোজার কম্পেনশেসন’ ওরফে ‘রেকা’ আইন চালু করে মার্কিন কংগ্রেস।
তেজস্ক্রিয়তার শিকার হওয়া নিউ মেক্সিকোর বাসিন্দাদের এককালীন ক্ষতিপূরণপ্রদানের বন্দোবস্ত করে এই আইন। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৯ হাজার পরিবারকে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সরকার। কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট?
সমাজকর্মীদের দেওয়া তথ্য বলছে অন্য কথা। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ইউরেনিয়াম খনির শ্রমিক এবং আকরিক পরিবহনকারীরা এই ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সার্বিকভাবে। পাশাপাশি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও, এককালীন ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় সেরেছে প্রশাসন।
সম্প্রতি, ‘রেকা’ আইন সংশোধন নিয়েই নতুন করে সরব হয়েছেন মার্কিন সমাজকর্মীরা এবং একাধিক সেচ্ছাসেবী সংস্থা। রেকা আইনের মেয়াদ সম্প্রসারণ এবং ধারাবাহিক ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা।
ইতিমধ্যেই গোটা পরিস্থিতি জরিপের অনুমোদন দিয়েছে বাইডেনের ডেক্স। আশ্বাস দিয়েছে, পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের। কিন্তু এই জটিল আইনের সংশোধন বেশ দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া।
বাইডেন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আদৌ কি প্রবর্তিত হবে সংশোধিত আইন? তা না হলে, পরবর্তী রাষ্ট্রপতির শাসনকালে এই লড়াই আবার শুরু করতে হবে শূন্য থেকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ