কলম্বিয়ার একটি আদালত চিকিৎসা সহায়তায় আত্মহত্যাকে (Medically Assisted Suicide) আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে । সেক্ষেত্রে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগী আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক হলে তিনি চিকিৎসা কর্মীদের সহায়তা পাবেন।
সেখানকার আইনজীবীদের মতে এই নিয়ম কার্যকর করার ক্ষেত্রে কলম্বিয়া এখন লাতিন আমেরিকার প্রথম দেশ হয়ে উঠেছে। তবে কলম্বিয়া ছাড়াও, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যও চিকিৎসা সহায়তায় আত্মহত্যার অনুমতি দেয় ।
এএফপি জানিয়েছে, গত বুধবার কলম্বিয়ার সর্বোচ্চ আদালতে ৬-৩ ভোটে ইচ্ছামৃত্যুর বিষয়টি পাস হয়। এতে বলা হয়, গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি যারা শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না, তারা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে, অনুমতি সাপেক্ষে এবং পরামর্শক্রমে নিজের জীবনাবসান ঘটাতে পারবেন। এর জন্য আদালত তাদের দোষী সাব্যস্ত করবেন না।
ইচ্ছামৃত্যু, যা বিশ্বব্যাপী ‘ইউথেনেসিয়া’ নামে পরিচিত। ইউথেনেসিয়া একটি গ্রিক শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ‘ভালো মৃত্যু’। ১৯৯৭ সালে ইউথেনেসিয়াকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছিল কলম্বিয়া। গত বছরের জুলাই মাসে আদালত এ ধরনের মৃত্যুকে ‘মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যুর অধিকার’ আখ্যা দিলে বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় আসে। এ নিয়ে অনেক বিতর্কের পর গত বুধবার সর্বোচ্চ আদালতে বিষয়টির পক্ষে বিপক্ষে ভোটাভুটির পর ইউথেনেসিয়া বৈধতা পায়।
কলম্বিয়ার সরকারি তথ্যমতে, অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলেও ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত কলম্বিয়ায় প্রায় ২০০ মানুষ মৃত্যুর জন্য ইউথেনেসিয়াকে বেছে নিয়েছেন।
বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশে ইউথেনেসিয়ার অনুমতি রয়েছে। লাতিন আমেরিকার প্রথম দেশ হিসেবে কলম্বিয়া সেই গুটি কয়েক দেশের অন্তর্ভুক্ত হলো। দেশটির বেশির ভাগ মানুষ রোমান ক্যাথলিক হওয়ার পরেও ইউথেনেসিয়া বৈধতা পাওয়াকে অনেকেই বিস্ময়কর হিসেবে দেখছেন। কারণ চার্চ স্পষ্টতই ইচ্ছামৃত্যু ও আত্মহত্যার বিরোধিতা করে থাকে।
গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি যারা শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না, তারা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে, অনুমতি সাপেক্ষে এবং পরামর্শক্রমে নিজের জীবনাবসান ঘটাতে পারবেন।
সংগত কারণে কলম্বিয়া এই মৃত্যুকে সরাসরি ইউথেনেসিয়া না বলে ‘সহায়তাকৃত আত্মহত্যা’ বলছে। দেশটির রাইট টু ডাই উইথ ডিগনিটি ফাউন্ডেশন (ডিএমডি) বলছে, ইউথেনেসিয়া ও সহায়তাকৃত আত্মহত্যার মধ্যে পার্থক্য হলো—মৃত্যুর জন্য ওষুধটি কে প্রয়োগ করছেন। ইউথেনেসিয়ার ক্ষেত্রে ওষুধটি একজন স্বাস্থ্যকর্মী নিজে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করেন। আর সহায়তাকৃত আত্মহত্যার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধটি রোগী নিজে প্রয়োগ করেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যেও চিকিৎসাসহায়তায় আত্মহত্যার অনুমতি রয়েছে।
বিশেষ ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডে আত্মহত্যায় সহায়তা প্রদান করা আইনি ভাবে বৈধ। সূত্রের খবর, গত বছর অন্তত ১,৩০০ মানুষ এই প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়েছেন। সংস্থার দাবি, এ বার আইনি বৈধতা পেল আত্মহত্যা করার যন্ত্র ‘সারকো’।
‘ডক্টর ডেথ’ হিসেবে খ্যাত চিকিৎসক ফিলিপ নিটশে বলছেন, ‘আগামী বছরের মধ্যে সারকো ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যাবে সুইজারল্যান্ডে। এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পে বহু অর্থব্যয় হয়েছে। কিন্তু আমাদের আশা, আমরা প্রয়োগের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি’।
তবে যন্ত্র নিয়ে সমালোচনাও কম হচ্ছে না। অনেকে বলছেন যে, এই যন্ত্রটি আসলে গ্যাস চেম্বারকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকের মতে, এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যাকে সব ক্ষেত্রে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত দু’টি এমন সারকো যন্ত্র তৈরি হয়ে রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা মাথায় রেখে আরও একটি যন্ত্রের থ্রি-ডি প্রিন্টিং শুরু করেছে এক্সিট ইন্টারন্যাশনাল। আগামী বছর থেকে সুইজারল্যান্ডে এই পরিষেবা দেওয়া শুরু করাই লক্ষ্য সংস্থার। যদিও তাতে বিতর্কের ঢেউ থামছে না।
স্টাইলিশ সুইসাইড মেশিন তৈরি করে নিটশে সবাইকে চমক দিতে চাইলেও, অনেকেই এতে নাখোশ। চিকিৎসাবিদরা বলছেন, এটা নৈতিকতা বিবর্জিত এবং মানুষের জন্য অমঙ্গলজনক। তারা বলছেন আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন নিটশে।
প্রতিবেদন অনুসারে, সারকো মেশিনটি সুইজারল্যান্ডে আইনি যাচাই-বাছাইয়ে পাস করার সাথে সাথেই এর নির্মাতারা এটিকে স্থাপন করবেন এবং আগামী বছর থেকে এটি সে দেশে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হবে।
আত্মহত্যার মেশিন তৈরির এমন অদ্ভুত চিন্তার পেছনে কাজ করেছিল ২০১২ সালে রাগবি খেলোয়ার টনি নিকলসনের ঘটনা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে দীর্ঘকাল সঙ্কটজনক অবস্থায় টনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুর দাবি জানিয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু অনুমতি না মেলায় রাগবি খেলোয়াড়কে যন্ত্রণা নিয়েই মৃত্যুবরণ করতে হয়।
তখনই ‘সারকো’ বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফিলিপ নিটশে। ঠিক করেছিলেন টনির মতো যারা আরোগ্যের অযোগ্য রোগে ভুগছেন তাদের কষ্টের হাত থেকে মুক্তি দেবেন। এখন দেখার বিষয় ‘সারকো’ স্বেচ্ছায় মৃত্যুতে আগ্রহীদের মধ্যে কতোটা সাড়া ফেলে।
১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরিতে ইনজেকশনে আত্মহত্যাকে বৈধ হওয়ার পর পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক হিসেবে নিটশে ৪ জনের আত্মহত্যার তত্ত্বাবধান করেন। এরপর তিনি আত্মহত্যার বৈধতা আদায়ে একটি এনজিও খোলেন, যার নাম দেন ‘এক্সিট ইন্টারন্যাশনাল’।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যেও বৈধতা পেয়েছে ইনজেকশন দিয়ে আত্মহত্যা। তবে ১৮ বছরের বেশি কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন রোগে আক্রান্ত হন, যাতে তার ৬ মাসের বেশি বাঁচার সম্ভাবনা নেই, তখনই এই ইনজেকশন ব্যবহার করা যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১২৭
আপনার মতামত জানানঃ