যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে স্থাপনা ও এলাকার মুসলিম নাম বদলে হিন্দু নাম রাখার ধুম পড়েছে। মুঘলসরাই, এলাহাবাদের পর ‘মিঞাগঞ্জ’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘মায়াগঞ্জ’ রাখার দাবি তোলা হয়েছে সম্প্রতি। তারও আগে মির্জাপুরের নাম বদলে ‘বিন্ধ্য ধাম’ করার দাবি উঠেছে। বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে স্থাপনা ও এলাকার মুসলিম নাম বদলে ফেলার ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যবাহী জেলা সুলতানপুরের নাম পরিবর্তন করতে চলেছে সেখানকার সরকার। হিন্দুত্ববাদী কতিপয় মৌলবাদী সংগঠনের দাবির অজুহাত দেখিয়ে জেলার নাম রামের পুত্র কুশের নামে অর্থাৎ কুশভবানপুর রাখার আলোচনা চালাচ্ছে যোগী আদিত্যনাথের সরকার।
এদিকে শাহজাহানের তৈরি তাজমহল কোনো দিন ‘তেজো মহালয়া’ নামে মন্দির ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখতে একটি তথ্য অনুসন্ধানী দল গড়ার আবেদন জানিয়ে ইলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চে সম্প্রতি আবেদন করেছিল বিজেপি।
তাজমহলের বন্ধ থাকা কক্ষগুলো খুলে তা খতিয়ে দেখারও আর্জি জানানো হয়। সেই ঘটনার রেশ কাটার আগেই এবার শাহাজহানের নামাঙ্কিত রাস্তার নাম বদলেরও দাবি জানাল বিজেপি। আবার কুতুব মিনারের নামবদল করে বিষ্ণু স্তম্ভ রাখার দাবি জানিয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনও। বিরোধীদের অভিযোগ, দৈনন্দিন সমস্যা থেকে নজর ঘোরাতেই নামবদলের কৌশল বিজেপির। আনন্দবাজারের খবর
আজ মহাকাল মানব সেবা এবং আরো কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধিরা প্ল্যাকার্ড হাতে উপস্থিত হন কুতুব মিনারের সামনে। ইউনেসকোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ তকমাপ্রাপ্ত এই স্থাপত্যের নামবদলের দাবিতে স্লোগানও দেয়া হয়। হনুমান চালিসাও পাঠ করেন তারা। পরিস্থিতি সামলাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয় সেখানে।
দিল্লির কিছু রাস্তার নাম বদলেরও দাবি জানিয়ে আজই সরব হয়েছে দিল্লি বিজেপি। উত্তর দিল্লি পৌরসভাকে চিঠি লিখে দিল্লি বিজেপির প্রধান আদেশ গুপ্ত জানিয়েছেন, শাহজহান রোড, তুঘলক রোড, আকবর রোড, আওরঙ্গজেব লেন, হুমায়ুন রোডের নাম পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছেন। বলা হয়েছে, মোগল আমলে দাসত্বের প্রতীক স্বরূপ এই রাস্তাগুলোর নাম পরিবর্তন করা হোক।
বিজেপি নেতা গুপ্তের পরামর্শ তুঘলক রোডের নাম বদলে করা হোক গুরু গোবিন্দ সিংহ মার্গ। একই ভাবে আকবর রোড, আওরঙ্গজেব লেন, হুমায়ুন রোড, শাহজহান রোডের নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে মহারানা প্রতাপ রোড, আব্দুল কালাম লেন, মহর্ষি বাল্মীকি রোড এবং জেনারেল বিপিন রাওয়ত করা হোক। এর পাশাপাশি বাবর লেনের নাম পাল্টে ক্ষুদিরাম বসুর নামে রাখার প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি।
শাহাজহানের নামাঙ্কিত রাস্তার নাম বদলেরও দাবি জানাল বিজেপি। আবার কুতুব মিনারের নামবদল করে বিষ্ণু স্তম্ভ রাখার দাবি জানিয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনও।
প্রসঙ্গত ২৪ আকবর রোডে রয়েছে কংগ্রেসের সদর দফতর। রাস্তার নাম বদলের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে ১৩ সদস্যের উত্তর দিল্লি পৌরসভা। নাম বদলের প্রস্তাব এলে সাধারণত প্রস্তাবিত নামটির সাথে জড়িত ইতিহাস, ভাবাবেগ প্রভৃতি বিষয় বিচার করা হয়। কিন্তু উত্তর দিল্লি পৌরসভায় নাম বদলকে ব্যতিক্রমী বিষয় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে সেখানে দিল্লি বিজেপির প্রধানের আবেদন কীভাবে দেখা হবে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিক দলিল বা তথ্যকে উপেক্ষা করে যখন কেউ বা কারা ইতিহাস নিয়ে বুলি আওড়ান, তখন তাদের ‘বোধহীন’ অথবা ‘বিকৃতমনষ্ক’ বলে দাবি করতে হয়। কিন্তু বিজেপি কিংবা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বোধহীন নন। তিনি একজন রাজনীতিবিদ। অতীতে রাজনীতির ময়দানে তিনি বহু বিতর্কিত ঘটনা ঘটিয়েছেন। বহুবার বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন এবং সেই বিতর্ক সামলেও নিয়েছেন। তিনি জানেন, রাজনীতির ময়দানে কীভাবে কোন দিকে বল বাড়িয়ে গোল করতে হয়।
তারা বলেন, রাজনীতি, রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে কারো দ্বিমত থাকতেই পারে। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বিভিন্ন মতামত, বিভিন্ন কণ্ঠ থাকবে, সেই তো স্বাভাবিক। তিনি বা তার দল ইতিহাস নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। সেই মত অনেকের সঙ্গে না-ই মিলতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের ব্যাখ্যা যখন তথ্যবিকৃত হয়ে যায়, তখন তাকে প্রশ্ন করার, কাঠগড়ায় তোলার যথেষ্ট কারণ থাকে। আঙুল তুলে তাকে প্রশ্ন করতেই হয়, কেন এই মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন?
বিশ্লেষকরা বলেন, বলতে দ্বিধা নেই, তাদের ইতিহাসের যথেষ্ট জ্ঞান নেই। তা নিয়ে তারা যে আজগুবি কথা বলছেন, তার পিছনে আবার একটি মস্ত চক্রান্ত রয়েছে। গৈরিক ঐতিহাসিকরা ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় নতুন ব্যাখ্যার আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে সেই বিতর্ক হলে তর্ক করতে অসুবিধা নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কিন্তু তারা যে ইতিহাস বলছেন, তা বিতর্কেরও অযোগ্য।
তারা বলেন, তারা আসলে ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। তাদের রাজনীতিটা হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি। তাই অতীতের অ-হিন্দু শাসন তাদের কাছে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সে জন্যই ইতিহাস বদলে দেয়ার চেষ্টা। এটা কট্টর মানসিকতাকে তুষ্ট করবে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে নজর অন্যদিকে ঘোরাবে। হয়তো বা ভোট পেতেও ঢালাও সাহায্য করবে। তবে বলে রাখা ভালো, এক বা একাধিক ব্যক্তি শত চেষ্টা করলেও ইতিহাস বদলাবে না। ঐতিহাসিক দলিল আগুন দিয়েও পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিন্তু সত্যকে আড়াল করা যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৭
আপনার মতামত জানানঃ