সমুদ্রদানো বা মেগালোডনরা সমস্ত পৃথিবীতে রাজত্ব করে বেড়িয়েছে। তাদের ফসিল আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। উপকূল থেকে গভীর সমুদ্র সব জায়গাতেই মানিয়ে নিয়েছিলো তারা নিজেদের।
যদিও শিশু মেগালোডনরা মূলত উপকূলবর্তী এলাকায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ থেকে তাদের দেহাংশ উদ্ধার হয়েছে। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশও মেগালোডনের খপ্পর থেকে বঞ্চিত হয়নি।
ড্যানিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী নিকোলাস স্টেনো এমন কিছু অদ্ভুত হাড়ের কথা শুনলেন যেগুলোকে লোকে বিভিন্ন পাথর থেকে সংগ্রহ করেছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকগুলোর বিশ্বাস, এগুলো প্রাগৈতিহাসিক ড্রাগনের জিহ্বা।
নিকোলাস স্টেনো সেগুলো দেখে বুঝতে পারলেন, এক মহামূল্যবান আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি। তার বুঝতে অসুবিধা হলো না, এগুলো জিহ্বা নয়, বরং দাঁত, অতিকায় কোনো প্রাণীর বিধ্বংসী দাঁত।
তিনি বিস্তর গবেষণা করে ১৬৬৭ সালে একখানা বই লিখলেন, নাম ‘The Head of a Shark Dissected’। সেখানে বিস্তারিত লিখলেন তার গবেষণার ফলাফল। এমনকি দাঁতের উপর ভিত্তি করে কেমন হতে পারে প্রাণীটির চোয়াল এর একটি চমৎকার ইলাস্ট্রেশন আঁকলেন।
সুইস বিজ্ঞানী লুইস এগাসিজ প্রাণীটির নামকরণ করলেন মেগালোডোন। কথাটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘মেগাস’ (বৃহদাকার) এবং ‘অগাস’ (দাঁত) থেকে, অর্থাৎ মেগালোডন শব্দের অর্থ দাঁড়ায় দৈত্যাকার দাঁতালো প্রাণী। যদিও কেউ কেউ একে ভালবেসে ‘দ্য জায়ান্ট হোয়াইট শার্ক’ কিংবা ‘মনস্টার শার্ক’ বলেও ডাকে।
একেবারেই যথার্থ নামকরণ। পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে ভয়ংকর দাঁত খুব কম প্রাণীরই আছে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রমাণ সাইজের হাতের সমান একেকটি দাঁত।
সবচেয়ে বড় যেটি পাওয়া গেছে সেটি সাত ইঞ্চি লম্বা আর মানানসই সাইজের চওড়া। বর্তমান পৃথিবীর ভয়ানক হোয়াইট শার্কের দাঁত তিন ইঞ্চি হয় কদাচিৎ। ত্রিকোণাকৃতির দাঁতগুলো ক্রমশ সরু হয়ে সুঁচালো আকার ধারণ করেছে। শুধু দাঁতই নয়, এদের আকারও ছিল দশাসই।
দাঁত এবং কশেরুকা ছাড়া মেগালোডনের আর কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। তাই এদের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন। তারপরও নিকটতম আত্মীয় হোয়াইট শার্কের সাথে তুলনা করে এবং ফসিল পুনঃবিন্যাস করে বিজ্ঞানীরা এদের ব্যাপারে আমাদের মোটামুটি একটি ধারণা দিয়েছেন।
একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মেগালোডন লম্বায় গড়ে দশ মিটার থেকে শুরু হয়ে আঠার মিটারের কাছাকাছি। অন্য একটি হিসাব থেকে জানা যায়, মেগালোডন লম্বায় পঁচিশ মিটারের কাছাকাছি।
আর ওজন দশ টন থেকে শুরু হয়ে পঁয়ষট্টি মেট্রিক টন পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। এমন লম্বা রেঞ্জের বৈচিত্র্যতার পেছনে একটি কারণ আছে, তা হলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়া এবং খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য। সাধারণত পৃথিবীর উত্তরাঞ্চল থেকে পাওয়া ফসিলগুলো থেকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ফসিলগুলো বৃহদাকার।
তবে আকার-আয়তনে ভিন্নতা থাকলেও এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, মেগালোডন ছিল এক অব্যর্থ জীবন্ত মারণাস্ত্র। আসলেই তাই। তার ভয় উদ্রেককারী আকার আর দাঁত দিয়ে সাগরে একচ্ছত্র রাজত্ব করে গেছে।
সমুদ্রের আলফা লেভেলের শিকারী ছিলো এরা। মানে এরা ছিলো শিকারীদের মধ্যে সবার উপরে। ছোট মাছ থেকে শুরু করে সীল, সামুদ্রিক কচ্ছপ দিয়ে হরহামেশাই উদরপূর্তি করতো। বাদ যেত না ডলফিন বা স্বগোত্রীয় অন্য ছোট হাঙ্গরেরা। এমনকি সমুদ্রতলে পাওয়া তিমির কশেরুকায় গভীর ক্ষত এবং তার পাশে পড়ে থাকা মেগালোডনের দাঁত থেকে বোঝা যায় হতভাগ্য বো-হেড তিমিগুলো তাদের প্রকাণ্ড শরীর নিয়েও মাফ পায়নি।
মেগালোডনরা ছিল উষ্ণ রক্তের প্রাণী। এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাদের জন্য। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ ঠান্ডা হওয়া শুরু করে। ফলে তারা যে খাদ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল তারাও খাদ্যের অভাবে কমে যেতে থাকে এবং বরফ যুগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে অনেক প্রাণী মেরু অঞ্চলে চলে যায়।
মেগালোডনের পক্ষে তাদের পিছু নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাদের শরীরকে উষ্ণ রাখার জন্য তারা উষ্ণ জলের উপর নির্ভরশীল ছিল।
তাছাড়া বরফ যুগের আগমনের সাথে সাথে সমুদ্রতলের উচ্চতা কমে যায়। ফলে তাদের চারণক্ষেত্র কমে যেতে থাকে। এ সময় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেয় খুনে তিমি সহ আরো কিছু শিকারী প্রাণী।
এভাবে আস্তে আস্তে মেগালোডন হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে। মেগালোডনের বিলুপ্তি জীবজগতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে বালিন তিমিরা নিজেদের আকার বাড়িয়ে নিয়েছিল খুব দ্রুত।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ