আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এই অবস্থায় রিজার্ভ বেশি থাকলে, ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ পর্যাপ্ত হলে, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ চলমান থাকলে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হতো।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত ক্ষতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা কমছে। এর মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভ বাড়ার গতি থেমে গেছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট হওয়ায় এর দাম বেড়ে টাকার মান কমে যাচ্ছে। ফলে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহ কমা এবং ঋণপ্রবাহ বাড়ায় তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি তারল্যের জোগান দিতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। এসব মিলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলোর অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৬১৫ কোটি ডলার, যা গড়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। গত সেপ্টেম্বরে ছিল ৪ হাজার ৬২০ কোটি ডলার। যা ওই সময়ে ৬ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান ছিল। এর আগে করোনার আগে ২০১৯ সালের নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান রিজার্ভ ছিল। গত ২৩ মার্চ রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার। যা দিয়ে ৫ মাসেরও কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স-প্রবাহ কম থাকায় তা দিয়ে আমদানিসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকায় দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কমছে।
এদিকে আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া এবং রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে জোর দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দেশের দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে লাগামহীনভাবে। গত অর্থবছরের জুলাই জানুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৬ শতাংশের বেশি। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ। দেশের মোট আমদানির ৬০ শতাংশ ব্যয় মেটানো হয় রপ্তানি আয়ের অর্থ দিয়ে।
বাকি ৪০ শতাংশ মেটানো হয় রেমিট্যান্স থেকে অর্থ নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় তা দিয়ে আমদানিসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে ডলারের জোগান দিতে হচ্ছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে গত ৯ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৩৭৯ কোটি ৭০ লাখ ডলারের জোগান দেওয়া হয়েছে। ফলে রিজার্ভ কমেছে।
গত নয় মাসে রিজার্ভ কমেছে ২০৯ কোটি ডলার। এতে আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতাও কমে গেছে। যদিও আন্তর্জাতিক নিরাপদ মান অনুযায়ী কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলেই তাকে নিরাপদ ধরা হয়। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের মতে অর্থনীতিতে ঝুঁকির প্রবণতা বাড়লে কমপক্ষে ৫ মাসের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। বর্তমানে করোনা ও যুদ্ধের প্রভাবে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। ফলে আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য রিজার্ভও বেশি থাকতে হবে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়ছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। এর বিপরীতে আমদানি বেড়েছে ৪৬ শতাংশের বেশি। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স বেড়েছিল ৩৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ২০ শতাংশ। ফলে সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে গেছে।
অন্যদিকে আমদানি খাতের চলতি ব্যয়সহ বকেয়া দেনা পরিশোধ, চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমণ খাতে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বাড়ায় সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই জানুয়ারি সময়ে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ১৫৫ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৬ কোটি ডলার। এতে বিনিময় হারে চাপ পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হিসাবে টাকার মান কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ।
এদিকে সার্বিকভাবে ঋণপ্রবাহ বাড়লেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনো বেশ কম রয়েছে। বিনিয়োগও মন্দা বিদ্যমান। ফলে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কমছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ৮৩ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল বেসরকারি খাতের। গত ডিসেম্বরে তা কমে ৮২ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণের অংশ কমে গেছে। অথচ জিডিপিতে বেসরকারি খাতের অবদানই বেশি। মোট কর্মসংস্থানের ৫ শতাংশ সরকারি খাতে। বাকি ৯৫ শতাংশই বেসরকারি খাতে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই জানুয়ারিতে বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির। আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমায় বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলোর অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এই অবস্থায় রিজার্ভ বেশি থাকলে, ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ পর্যাপ্ত হলে, বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ বাড়লে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হতো। কিন্তু এগুলো হচ্ছে না।
এখন বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকে সঞ্চয় বাড়িয়ে তারল্য বৃদ্ধি করতে হবে। ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ