ইউক্রেন আক্রমণের আশঙ্কায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়ার উপর সর্বাধিক চাপ প্রয়োগ করতে চলেছে, রাশিয়ান নেতা ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্ব মঞ্চে তার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশীদার চীনের কাছ থেকে স্বস্তি পেয়েছেন। চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর বিরুদ্ধে পুতিনের অভিযোগের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপে বাধা দেয়ার চেষ্টা করার জন্য রাশিয়ার সাথে যোগ দিয়েছে এবং রাশিয়ার আগ্রাসন ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি’ তৈরি করবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করেছে।
এদিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বৃহস্পতিবার(২১ এপ্রিল) বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ-এর একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। এই প্রস্তাবে ‘অবিভাজ্য সুরক্ষার’ নীতি ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে। এই উদ্যোগটির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে রাশিয়াও। অবশ্য কীভাবে তা বাস্তবায়িত হবে তা সম্পর্কে চীনা প্রেসিডেন্ট বিস্তারিত জানাননি। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এখবর জানিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে জিনপিং এ প্রস্তাব দেন।
এশিয়ার ২৫টি দেশ ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সংস্থাটির বার্ষিক এ সম্মেলনে দেওয়া ভিডিও ভাষণে শি জিনপিং বলেন, ‘চীন একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ হাজির করতে পারে, যা নিরাপত্তার অবিভাজ্যতার নীতি বজায় রাখবে। আমাদের উচিত নিরাপত্তার অবিভাজ্যতা নীতি বজায় রাখা; ভারসাম্যপূর্ণ, কার্যকর ও স্থিতিশীল নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা এবং অন্য দেশকে অনিরাপদ করে এমন জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিরোধিতা করা।’
বক্তব্যে তিনি বলেন, রাশিয়াও সম্প্রতি পশ্চিমা সরকারগুলোকে ‘অবিভাজ্য নিরাপত্তা’ নীতির ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৯ সালে হওয়া একটি সমঝোতার প্রতি সম্মান দেখাতে চাপ দিচ্ছে। ওই সমঝোতা অনুযায়ী, কোনো দেশই অন্য দেশের নিরাপত্তা খর্ব করে নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বেইজিং এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানায়নি। একে মস্কোর পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে অস্ত্রনিরপেক্ষ দেশে পরিণত করার ‘বিশেষ অভিযান’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বেইজিং ইউক্রেন সংকটের জন্য ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণকেই দায়ী করছে। বিশ্নেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষাপট ও এশিয়ায় মার্কিন কর্মকাণ্ডের প্রভাবের বাইরে এই প্রথম ‘অবিভাজ্য নিরাপত্তা’র পক্ষে যুক্তি দিয়েছে চীন।
এর কারণ হিসেবে সিঙ্গাপুরের এস রাজানাথনাম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক লি মিনজিয়াং বলেন, ‘চীন যদি মনে করে তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরে তার নিরাপত্তা উদ্বেগকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা উপেক্ষা করছে, তাহলে তারা যাতে একটি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নৈতিক অবস্থান দাবি করতে অবিভাজ্য নিরাপত্তা তত্ত্বকে তুলে ধরতে পারে।’
রাশিয়াও সম্প্রতি পশ্চিমা সরকারগুলোকে ‘অবিভাজ্য নিরাপত্তা’ নীতির ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৯ সালে হওয়া একটি সমঝোতার প্রতি সম্মান দেখাতে চাপ দিচ্ছে। ওই সমঝোতা অনুযায়ী, কোনো দেশই অন্য দেশের নিরাপত্তা খর্ব করে নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে না।
হংকংয়ের সিটি ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ওয়াং জিয়ানজিয়ু বলেন, ইউরোপ থেকে উদ্ভূত এই অবিভাজ্য নিরাপত্তা ধারণা সামনে আনার মাধ্যমে চীন তার মূল স্বার্থরক্ষায় তার পদক্ষেপগুলোকে অন্যান্য দেশের কাছে বৈধ হিসেবে তুলে ধরতে চায়।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে জিনপিং যখন বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রস্তাব দিচ্ছেন তখন চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংহে ফোনালাপে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন।
ওয়েই বলেন, ‘যদি তাইওয়ান ইস্যুর সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না হয়, তবে এটি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে।চীনা সামরিক বাহিনী দৃঢ়ভাবে সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করবে।’ ভার্চুয়াল বৈঠকে তারা সমুদ্র, আকাশ নিরাপত্তা এবং ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
ভাষণে শি জিনপিংও একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও ‘বিদেশিদের আইনি হস্তক্ষেপে’র বিরুদ্ধে চীনের অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরেন। তবে ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলো যেসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সেগুলোর প্রসঙ্গ সরাসরি উল্লেখ করেননি তিনি।
চীনের প্রেসিডেন্ট এদিন পশ্চিমাদের সতর্ক করে বলেন, অর্থনৈতিকভাবে পৃথক করে দেওয়ার চেষ্টা এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ছিন্নের মতো চাপ প্রয়োগের কৌশল কাজে আসবে না।
রাশিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞাসহ চীন ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করে এলেও মস্কোকে সহায়তার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করছে। কারণ মস্কোকে সহায়তা বেইজিংয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথ করে দিতে পারে। বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে শি বলেন, এখন বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করার চেষ্টা জরুরি। তিনি আরও বলেন, চীনের অর্থনীতি স্বাভাবিক হচ্ছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা বদলায়নি।
চীনকে নিয়ে নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় রাশিয়া। চীন সফররত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গত বুধবার(৩১ মার্চ) এক ভিডিও বার্তায় এই আকাঙ্ক্ষার কথা জানান ।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর এটিই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম চীন সফর। এ সময় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ চীনের তুনসি শহরে মিলিত হন। ইউক্রেন সংকটের মাঝে এই বৈঠককে ঘিরে উত্তেজনার আশঙ্কা আরও বেড়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে।
দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভিডিওতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ বলেন, ‘চীন এবং রাশিয়া একটি নতুন ন্যায়সঙ্গত, গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছে’।
ভিডিওতে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে বিশ্ব একটি গুরুতর পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আপনারাসহ (চীন) আমরা মিলে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলো নিয়ে একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক, ন্যায়পরায়ণ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাব।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার এখনো এর নিন্দা জানায়নি বেইজিং। পাশাপাশি রাশিয়াকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে চীন সহযোগিতা করতে চাচ্ছে, এমন অভিযোগ তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। এমন পথে না হাঁটতে সম্প্রতি এক ভিডিও কনফারেন্সে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে সতর্ক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
তবে পরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন সাংবাদিকদের বলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে মস্কো ও বেইজিং কাজ করে যাবে।
এর আগে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি এক যৌথ বিবৃতিতে চীন এবং রাশিয়া বলেছিল, ‘দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে কোনো সীমারেখা নেই’। আর ২৮ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ বলেছেন, চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক এখন সর্বকালের সর্বোত্তম পর্যায়ে রয়েছে।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শুধু সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বা রাশিয়ার চাওয়া নয় ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের পক্ষ নিয়ে আমেরিকাকে কোণঠাসা করার পেছনে চীনের নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।
ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ক্রিস মিলার বলেন, ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপসহীন অবস্থান দেখে চীন তাইওয়ান নিয়ে চিন্তিত। চীন মনে করছে তাইওয়ান বা দক্ষিণ চীন সাগরের ইস্যুতেও যে তারা এমন কঠোর অবস্থান নেবে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন নিয়ে রেষারেষিতে সফল হোক, চীন তা চায় না। ইউক্রেনের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও বা সে দেশে রুশ সামরিক অভিযানে অস্বস্তি বোধ করলেও কোনো যুদ্ধ বাধলে চুপ করে থাকা চীনের জন্য এ দফায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৪
আপনার মতামত জানানঃ