সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি করছেন।
১৯৪৮ সালে ব্রিশিট শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে এই দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। খাদ্য সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি এবং বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশটির এসব সঙ্কটের জন্য সরকারকেই দায়ী করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানীতে এসেছে পড়েছে। এটাকেই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা না থাকার অর্থ হলো প্রধান খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানী আমদানীর জন্য যথেষ্ট অর্থ নেই। ফলে খাদ্য সঙ্কট এবং মূল্যস্ফীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
একটানা গত ছয় মাস দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। ষষ্ঠ মাসে এসে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে দেশটির মূল্যস্ফীতি। এই অবস্থায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) অনুরোধ জানিয়েছে দেশটি।
এক বছরের ব্যবধানে গত মার্চে দেশটির বোর্ড ভিত্তিক জাতীয় ভোক্তা মূল্য সূচক (এনসিপিআই) বেড়েছে ২১.৫ শতাংশ যা গত বছরের তুলনায় চার গুণেরও বেশি। গত বছর মার্চে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
দেশটির আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান বিভাগের দেয়া সর্বশেষ তথ্যানুসারে, মার্চে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ডিজেলের দাম ৬৪ দশমিক ২ শতাংশ বাড়িয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি।
এমন অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের জরুরি সহযোগিতা চেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি। তবে দেশটির ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারের ঋণ ‘টেকসই নয়’ বলে জানিয়েছে আইএমএফ। তাই সহায়তা দেয়ার আগে দেশটিকে ঋণ পুনর্গঠন করার কথা জানায় সংস্থাটি।
এক বছরের ব্যবধানে গত মার্চে দেশটির বোর্ড ভিত্তিক জাতীয় ভোক্তা মূল্য সূচক (এনসিপিআই) বেড়েছে ২১.৫ শতাংশ যা গত বছরের তুলনায় চার গুণেরও বেশি। গত বছর মার্চে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অচলাবস্থার ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এদিকে দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি অভিযোগ এনে তার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ চলছে দেশজুড়ে। বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গত মঙ্গলবার মধ্য শ্রীলঙ্কার রামবুক্কানা শহরে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের ছোড়া গুলিতে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন প্রায় ৩০ জন।
সরকার এ পরিস্থিতির জন্য করোনা মহামারিকে দায়ী করছে। সরকার বলছে মহামারির কারণে পর্যটন ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। তাছাড়া তিন বছর আগে দেশটিতে ভয়াবহ বোমা হামলার কারণেও পর্যটক কমে গেছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছে, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী।
শ্রীলঙ্কায় দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় হয়েছে আকাশচুম্বী। খাদ্যপণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ৩০%। এর অনেক কারণ থাকলেও অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ৩০ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ। যে গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। এর পর শ্রীলঙ্কা রপ্তানী বাড়ানোর দিকে মনযোগ না দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের দিকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। সে কারণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে কম। যদিও আমদানী ব্যয় বাড়তে থাকে। সমালোচকরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় সব বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করতে যেয়ে সরকারও বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ করেছে।
২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭শ কোটি ৬০ লাখ ডলার। কিন্তু ২০২০ সালে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় মাত্র ২শ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে কর কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। যার অর্থ দাঁড়ায় রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য সরকার বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে সরকারের হাতে তেমন অর্থ থাকে না। ২০২১ সালে বৈদেশিক মুদ্রা যখন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তখন মুদ্রা সংরক্ষণে সরকার রাসায়নিক সার আমদানীতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কৃষককে অর্গানিক সার প্রয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ পদক্ষেপের ফলে কৃষি উৎপাদনও ব্যাপক হারে কমে যায়। খাদ্যের চাহিদা মেটাতে আমদানীর উপর নির্ভর করতে হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আরো প্রকট হয়ে ওঠে।
সেসময় থেকে সরকার দৈনন্দিন ব্যাবহারের বাইরের পণ্য যেমন গাড়ী, জুতা, নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যদ্রব্য আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দেশি মুদ্রার মান কমিয়ে অনেক সময় বিভিন্ন দেশ রপ্তানী আয় বাড়িয়ে থাকে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা সরকার দেশী মুদ্রার মান কমাতে অস্বীকৃতি জানায়।
শেষ পর্যন্ত দেশটির সরকার এ বছরে এসে মুদ্রার মান কমাতে বাধ্য হয়। ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যান হয় ৩০% পর্যন্ত।
এক দশক আগেও শ্রীলঙ্কা ছিল অন্য রকম; তামিল টাইগাররা পর্যুদস্ত, গৃহযুদ্ধের অবসানে দেশটি যেন উড়ছিল। পর্যটননির্ভর দ্বীপরাষ্ট্রটির অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠছিল; আসছিল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার; তা রোশনাই ছড়াচ্ছিল দোকানগুলোতে, আর সড়কে দেখা মিলছিল চকচকে সব গাড়ির।
আর দশককাল বাদে সেই শ্রীলঙ্কায় সড়কে এখন বাতি জ্বলছে না, গাড়ি চালাতে মিলছে না জ্বালানি তেল, কাগজের অভাবে পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী।
বিশাল অঙ্কের ঋণ, তার সঙ্গে মহামারীর খাঁড়ার পর ইউক্রেইন যুদ্ধ একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে সোয়া ২ কোটি মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কাকে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই কমেছে যে তা দিয়ে এক মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ