সম্প্রতি দেশে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব অপরাধ ও অপকর্মের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা ও ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এমনকি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মতো ঘৃণ্য অপরাধও আছে।
পুলিশ সবচেয়ে বড় ভিলেনে পরিণত হয়েছে এই সময়ে। বর্তমানে পুলিশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে মামলা হয়েছে এবং বিচার চলছে। এর মাঝেই চুয়াডাঙ্গায় অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ একই পরিবারের ৭ জনকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
সদর উপজেলার কুন্দিপুর গ্রামে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এর মধ্যে একজনকে ভর্তি রেখে বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
আহতরা হলেন, কুন্দিপুর গ্রামের জমেলা খাতুন, তার তিন ছেলে ইসরাফিল হোসেন, হোসেন আলী ও মুসা করিম, ইসরাফিলের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জাকিয়া খাতুন, মুসা করিমের স্ত্রী সাবিনা খাতুন ও হোসেনের স্ত্রী শিউলি খাতুন।
তবে, পুলিশের দাবি কাউকে মারধর করা হয়নি।
পুলিশ জানায়, গত মঙ্গলবার কুন্দিপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে হোসেন আলীর সঙ্গে একই এলাকার কদম আলীর ছেলে মোস্তফা সঙ্গে ঈদে গরুর মাংসের জন্য করা সমিতির টাকা দেওয়াকে কেন্দ্র করে মারামারি ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত মোস্তফা হোসেন আলীকে অভিযুক্ত করে দর্শনা থানায় একটি অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের তদন্ত করতে বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে হিজলগাড়ী পুলিশ ক্যাম্পের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মজিবর রহমান কুন্দিপুর গ্রামে যান। তাদের দেখে অভিযুক্ত হোসেন আলী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় বাড়ির টিনে হোসেনের কপাল কেটে যায়। রক্ত বের হতে দেখলে পুলিশের ওপর চড়াও হয় পরিবারের লোকজনসহ গ্রামবাসী। একপর্যায়ে হিজলগাড়ী ক্যাম্প পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে ফিরে আসেন। তবে কাউকে মারধর করা হয়নি।
আহত হোসেন আলীর মা জোমেলা খাতুন বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে হিজলগাড়ী ক্যাম্পের দুই পুলিশ সদস্য গ্রামে আসলে আমার ছেলে ভয়ে পালিয়ে যায়। পরে আমার ছেলেকে ধাওয়া করে ধরে বেধড়ক মারধর করে। এতে আমার ছেলের কপাল কেটে রক্তপাত হলে অজ্ঞান হয়ে যায়। খবর পেয়ে হোসেনের স্ত্রীসহ আমরা ঘটনাস্থলে গেলে আমাদের দেখে পুলিশ চলে যায়। পরে দর্শনা থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ আসলে আমরা প্রতিবাদ করি। এতে পুলিশ সদস্যরা আমাকে গুলি করারও হুমকি দেয়। পুরুষ পুলিশ সদস্যরা আমাকেসহ তিন পুত্রবধূ ও আমার তিন ছেলেকে বেধড়ক মারধর করে।
আহত জাকিয়া খাতুন বলেন, আমি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার স্বামীসহ আমি ঘটনাস্থলে যাই। পুলিশ মনে করেছে যে আমরা তাদের ওপর হামলা করতে গিয়েছি। পরে আমার স্বামীকে খুঁজতে আমার ঘরে আসে পুলিশ। ঘরের মধ্যে আমার স্বামীকে ধরে গুলি করার জন্য বন্দুক তাক করে। আমি সামনে গেলে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার পায়ে আঘাত করে এবং ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় পুলিশ সদস্যরা। সেখানে কোনো নারী পুলিশ ছিল না। একজন নারীকে কীভাবে পুরুষ পুলিশ সদস্য মারধর করে? আমরা এর বিচার চাই।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ডা. হাসনাত পারভেজ শুভ গণমাধ্যমকে বলেন, হোসেন আলীর মাথাসহ চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে তাকে শক্ত কোনো লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।
দর্শনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএইচএম লুৎফুল কবীর বলেন, আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। পুলিশ কাউকে মারধর করেনি। একটি অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়েছিল হিজলগাড়ী পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা। পরে অভিযুক্ত পালানোর সময় কপাল কেটে গেলে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয়দের হাতাহাতি হয়।
চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, পুলিশ কাউকে মারধর করেনি। পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে যায়, কাউকে মারধর করতে যায় না। হতে পারে আত্মরক্ষার্থে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। আগামীকাল (আজ) দর্শনা থানায় উভয়পক্ষকে নিয়ে বসা হবে। যে-ই দোষী হবে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
গত কয়েক বছরে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমছে। গত কয়েক বছরে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্ত্রীর দায়ের করা যৌতুক মামলায় পুলিশের এক সহকারী উপপরিদর্শককে (এএসআই) কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম আরেফিন আহমেদ এ নির্দেশ দেন। ওই এএসআইয়ের নাম হুমায়ূন কবির, বর্তমান কর্মস্থল লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশের হাজিরহাট তদন্ত কেন্দ্রে। তিনি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বাসিন্দা।
আদালত ও মামলার নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৫ মে কুমিল্লার দেবীদ্বারের ছোট শালঘর গ্রামের তারু মিয়ার মেয়ে খাদিজা আক্তারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে হুমায়ূন কবিরের বিয়ে হয়। বিয়ের পর খাদিজা একটি মেয়ে ও একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। তিন-চার মাস আগে হুমায়ূন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানায় সহকারী উপপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সাত-আট মাস আগে থেকে পদোন্নতির জন্য শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। টাকা না দিলে আরেকটি বিয়ে করবেন বলে শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে হুমকি দেন।
মামলা সূত্রে আরও জানা যায়, গত বছরের ২১ ডিসেম্বর মেয়ে বাবা হুমায়ূন কবিরের মুঠোফোনে গেমস খেলছিল। এ সময় মুঠোফোনে তার সঙ্গে অন্য আরেকটি মেয়ের অন্তরঙ্গ ছবি দেখতে পেয়ে মাকে দেখায় মেয়ে। খাদিজা এ বিষয়ে স্বামীর কাছে জানতে চান। তখন বাবার বাড়ি থেকে ১০ লাখ টাকা এনে না দিলে মুঠোফোনের ছবিতে থাকা মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলে হুমকি দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান হুমায়ূন। এরপর একাধিকবার চেষ্টা করলেও হুমায়ূন আর স্ত্রীর ফোন ধরেননি। এ ঘটনায় স্ত্রী খাদিজা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে সেখানে আলোচনা সাপেক্ষে স্বামী-স্ত্রীকে মিলিয়ে দেওয়া হয়।
বাদীর আইনজীবী বলেন, ওই ঘটনার পর খাদিজার মা আমেনা বেগম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের পশ্চিম মেড্ডায় বেড়াতে আসেন। গত ৪ মার্চ হুমায়ূন মামাশ্বশুর মো.ওয়ালিউল্লাহ ও স্ত্রীর বড় ভাই কাওসার মিয়ার সামনে শাশুড়ির কাছে নিজের পদোন্নতির জন্য পুনরায় ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। সেই টাকা দিতে অপরাগতা জানালে হুমায়ূন তাঁর স্ত্রী খাদিজার সঙ্গে সংসার করবেন না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এরপর হুমায়ূন আর স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
যৌতুক দাবির এসব ঘটনায় এএসআই হুমায়ূনকে আসামি করে খাদিজা বাদী হয়ে ১১ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে একটি মামলা করেন। পরে আদালত পুলিশের ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বৃহস্পতিবার আদালতে জামিন আবেদনে নিয়ে হাজির হন হুমায়ূন। আদালত তাঁকে জামিন না দিয়ে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে এটা বলবো না৷ বলা উচিত এই প্রবণতা আগেও ছিল, এখনো আছে৷ আগে সেভাবে গণমাধ্যমে আসত না, এখন আসছে৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও আগে সেভাবে খেয়াল রাখত না, এখন রাখছে৷ ফলে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে৷
তারা মনে করেন, পুলিশের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়নি৷ তাদের কিছু বিভাগ বেড়েছে সত্যি, কিন্তু সেই ব্রিটিশ নিয়মেই তারা চলে৷ আর এই সংস্কারটা হচ্ছে না এর কারণ পুলিশকে অনেক বেশি রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়৷ পুলিশের মধ্যে এমন কোন ক্যারিশমেটিক নেতা আসেনি যে তারা নিজের উদ্যোগেই সংস্কার করবে৷ আর আমাদের অর্থনীতি যেভাবে বেড়েছে তাতে পুলিশের মধ্যে এই দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে৷ অনেকেই অল্প দিনে ধনী হতে চান ফলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৯
আপনার মতামত জানানঃ