কাজী ফয়সাল : ৯ ডিসেম্বর ২০২০; কেটে গেল চাঞ্চল্যকর বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ৮ বছর। ২০১২ সালের এই দিনে সরকার দলীয় সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য দিবালোকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের ক্যামেরার সামনে কুপিয়ে হত্যা করে বিশ্বজিৎ দাসকে। চাঞ্চল্যকর মামলা হলেও বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করা যায়নি। মামলার রায়ে বিচারিক পর্যবেক্ষণে আদালতের যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে, তা যেন সমগ্র বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। বিশ্বজিতের রক্তাক্ত লাশের ছবি আজ দেশের সব গণমাধ্যমেই ছাপা হয়েছে। তার সেই ছবি সাক্ষ্য দিচ্ছে বিচারহীনতার অন্ধকারে ডুবছে বাংলাদেশ।
যা ঘটেছিল
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সরকার বিরোধী হরতাল। হরতালের সমর্থনে পুরান ঢাকার জজ কোর্ট থেকে সরকারবিরোধী আইনজীবীরা একটি মিছিল বের করেন। বাহাদুর শাহ পার্কের কাছাকাছি গেলে মিছিলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় সেখানে আগে থেকে অবস্থান নেয়া কবি নজ্রুল এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীরা হরতাল সমর্থনকারী আইনজীবীদের ওপর হামলা করে। বিশ্বজিৎ দাস যাচ্ছিলেন তার নিজের কর্মস্থল দর্জি দোকানে।
ছাত্রলীগ কর্মীরা বিশ্বজিতকে শিবির আখ্যায়িত করে তার ওপর আক্রমণ করে। বিশ্বজিৎ ভয় পেয়ে কাছের একটি দোতলা ভবনের ডেন্টাল ক্লিনিকে আশ্রয় নেন। ছাত্রলীগের কর্মীরা সেখানে ঢুকে তাকে রড দিয়ে বেধড়কভাবে পেটাতে থাকে। বিশ্বজিৎ পালিয়ে আরেকটি ভবনে ঢুকলেও হন্তারকরা তাকে অনুসরণ করে তাদের আঘাত অব্যাহত রাখে। বিশ্বজিৎ প্রতিনিয়ত নিজেকে হিন্দু বলে দাবী করলেও খুনিরা ভ্রূক্ষেপ করেনি। রড এবং চাপাতির কোপে বিশ্বজিতের জামা ছিঁড়ে যায়, ভিজে যায় রক্তে। এরপরেও বিশ্বজিৎ পালানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অব্যাহত রডের আঘাত আর চাপাতির কোপে বিশ্বজিৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
এসময় পথচারীরা তাকে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করলেও বাধা দেয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। শেষে নিজেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দৌড় দেন বিশ্বজিৎ, কিন্তু শাঁখারিবাজারের একটি গলিতে গিয়ে জ্ঞান হারান। মুমূর্ষ অবস্থায় একজন রিকশাচালক বিশ্বজিতকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান এবং কিন্তু অব্যাহত রক্তক্ষরণের কারণে বাঁচানো যায়নি তাকে। ঘটনাস্থলে পুলিশ মাত্র ২০ গজের মধ্যে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সাংবাদিকেরাও ছাত্রলীগের বাধা এবং হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। বিশ্বজিৎ হত্যার ভিডিও গবমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে জনমানুষের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন।
বিচার না অবিচার
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পরিচালিত বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার প্রথম রায় প্রকাশিত হয় ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৩ তে। এই রায়ে বিচারিক আদালত অভিযুক্ত ২১ আসামীর মধ্যে ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৩ জনের যাবজ্জীবন ঘোষণা করেন। কিন্তু তখনও আসামীদের ১৩ জনই পলাতক, বাকি ৮ জন গ্রেফতার হয়েছিল। এই রায়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফেরে, কিন্তু স্বস্তির স্থায়িত্ব ছিল খুব কম সময়ের জন্য।
আসামীদের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের রায় সম্পূর্ণ ঘুরে যায়। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮ জন আসামীদের মধ্যে ২ জন বেকসুর খালাস, ৬ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং মাত্র ২ জন আসামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া আসামীদের মধ্যে ২ জনকে মুক্তি দেয়া হয়। উচ্চ আদালতের পুর্নাঙ্গ রায়ে আসামীর সংখ্যা ২১ থেকে কমে ১৭ তে নেমে আসে। আসামী সংখ্যা কমে আসার পরেও ১৩ জন আসামী এখনও পলাতক রয়েছে। এই রায়ে বিশ্বজিতের পরিবারের পাশাপাশি দেশের মানুষের মধ্যেও দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা আরও তীব্রতর হয়। রায়ের এই পরিবর্তন দেশের মানুষকে করেছে হতবাক।
রায়ের প্রতিক্রিয়াতে বিশ্বজিতের ভাই উত্তম দাস হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, “পাঁচ বছর পরে আজকে আরেকটা দুঃসংবাদ এটা। আজকের দিনটাতে যে এরকম কিছু শুনতে হবে আমরা আশাই করিনি। এটাই ঠিক যে সরকার যা চাইবে তা-ই হবে। সরকার যদি চাইতো যে অন্তত বিশ্বজিৎ এর ঘটনাটা সুষ্ঠু বিচার হোক-তাহলে হতো। কোথায় আটজনের মৃত্যুদন্ড সেখানে আসলো দুইজনে। কি বলবো বলার ভাষা নাই।”
আদালতের অসহায়ত্ব
আদালতের প্রকাশিত রায়ের পর্যবেক্ষণে মামলায় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনেক অনিয়ম এবং কার্যহেলার বিষয়গুলো পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। হত্যা মামলার বদলে অপমৃত্যুর মামলা করা, ময়নাতদন্তে গালিফলি ও অস্পষ্টতা, লাশ দ্রুত গ্রামে পাঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলা, তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি এবং পুলিশের অসহযোগিতার মত বিষয়গুলো নজরে এনে আদালত তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারিক আদালত আরও ব্যক্ত করেন, “ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অস্বচ্ছ তদন্তকাজ প্রতিরোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানে বিত্তশালী ও ক্ষমতাধররা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দায়মুক্তি পেয়ে যায়। অপরাধ করার পরও প্রভাব খাটিয়ে তারা খুব সহজেই তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যায়। এরকম অনেক মামলা আছে যেখানে পুলিশ, অপরাপর তদন্ত সংস্থা, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন দিয়ে অপরাধীকে সাহায্য করেছে।”
“অনেক সময় রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য তারা বেআইনিভাবে এমনটা করে থাকে। এভাবে অসৎ ও উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত কার্যক্রম চলতে পারে না। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে এবং তার জবাবদিহি থাকতে হবে।”
সরকার দলীয় আসামীদের পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তা এবং পুলিশের ভুমিকা বিশ্বজিৎ হত্যার সুষ্ঠু বিচারের বড় অন্তরায়ের সৃষ্টি করেছে, আদালতের পর্যবেক্ষণে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে আদালতেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে। প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা, গণমাধ্যমে তার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যদি আদালত ন্যায়বিচার না দিতে পারে, আসামীদের শাস্তির মুখোমুখি না করতে পারে, সেটা হতাশাজনক বৈকি।
ক্ষমতার রাজনীতির কোন্দল ও সরকারি ক্ষমতার ছত্রছায়ায় অপরাধ চর্চার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তারই বলি হতে হলো বিশ্বজিতকে। পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা এবং আইন-আদালতের অপারগতায় নিশ্চিত করা যায়নি চাঞ্চল্যকর এই হত্যার সুবিচার। মুক্তি পেয়েছে খুনিরা, অধরাই থেকে গেছে অধিকাংশ আসামী। এটা বাংলাদেশকে এক অন্ধকারের মুখোমুখি করে দিয়েছে। বিচারহীনতার এই অন্ধকারে ডুবে যেতে পারে জাতীয় জীবনের সমস্ত অর্জন।
এসডাব্লিউ/কাফ/আরা/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ
![Donate](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/xcard.jpg.pagespeed.ic.qcUrAxHADa.jpg)
আপনার মতামত জানানঃ