গত শুক্রবার রাতে কুমিল্লার সদর উপজেলার গোলাবাড়ি সীমান্তে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় রাজু। র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশে এটাই প্রথম ক্রসফায়ারের ঘটনা। কুমিল্লায় গত সপ্তাহে সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স মহিউদ্দিন হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ছিল রাজু।
কুমিল্লার কোতয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কমল কৃষ্ণ ধর জানান, রাজু নিহতের ঘটনায় কোতয়ালি মডেল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে র্যাব। তবে তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা হয়নি। কেন সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা হয়নি—সে বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।
উল্লেখ্য, গত ১০ ডিসেম্বর পুলিশ ও র্যাবের সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এই প্রথম বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল৷ তবে ওই নিষেধাজ্ঞার কয়েক ঘণ্টা আগেও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে৷ ১০ ডিসেম্বরের আগের পাঁচদিনে ক্রসফায়ারে পাঁচজন নিহত হয়েছে৷
১৮ জনের সাথে একা যুদ্ধ করলো!
রাজু অত্যন্ত ভালোমনের ছেলে ছিল। সে ভিক্টোরিয়া কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে ও বিচার-বিবেচনার সুযোগ না দিয়ে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ ঘটনায় ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছি—এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন কুমিল্লায় র্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযদ্ধে নিহত মোহাম্মদ রাজুর বাবা সাদেক মিয়া।
রাজুর বাবা আরো বলেন, আমার ছেলে কোনো অন্যায় করে থাকলে দেশে আইন-আদালত ছিল। কোনো যাচাই-বাছাই তদন্ত ছাড়া আমার ছেলেকে র্যাব মেরে ফেলল! র্যাব বলল, বন্দুকযুদ্ধে আমার ছেলে মারা গেছে।
তাহলে র্যাবের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনাদের ১৮ জনের সাথে একা যুদ্ধ করলো রাজু, তাহলে বন্দুকযুদ্ধের অস্ত্র কোথায় পেল? রাজুর এত সাহস এল কোত্থেকে? সে এত বড় দুর্ধর্ষ যোদ্ধা যে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটাল!
সবাই বলে, রাজু মাদকের গডফাদার। তবে, মহিউদ্দিন মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত তার বিরুদ্ধে মাত্র একটি মামলা করে বিজিবি। সেটি ছিল অস্ত্র মামলা। সেখানে তার থেকে একটি পাইপগান উদ্ধারের কথা বলা হয়। সেটি ভুয়া মামলা ছিল। আদালতে সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় কোনো মামলা করবেন কিনা—গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে সাদেক মিয়া জানান, তিনি কোনো মামলা করতে চান না। “আমি বিচার চাই না, বাকি দুই ছেলেকে নিয়েই ভয়ে আছি।”
কী বলছে র্যাব?
এদিকে, র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে কোন তদন্ত করা হচ্ছে না। তবে, যেকোনো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পরে যেভাবে চিকিৎসক, স্থানীয় থানা পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্ত হয়- এঘটনায়ও সেভাবেই হবে।
তিনি বলেন, এটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর প্রথম গুলি বিনিময়ের ঘটনা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও দুই-তিনবার অভিযানে গিয়ে গুলির মুখে পড়তে হয়েছে র্যাবকে। এই অভিযানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কোন সর্ম্পক নেই।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেছেন, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় যেভাবে তদন্ত হয়, কুমিল্লার ঘটনাটিকে তারা সেভাবে তদন্ত করবেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবেন।
যেভাবে আসামি হলেন রাজু
সাবেক সংবাদকর্মী মহিউদ্দিন জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের অলুয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেনের ছেলে। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণপাড়া হলেও তিনি সপরিবারে কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বসবাস করতেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বুড়িচং এলাকায় হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হলেও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় মাদক বিরোধী কর্মকাণ্ডে বেশ তৎপর ছিল মহিউদ্দিন। তিনি পুলিশ, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন।
গত বুধবার (১৩ এপ্রিল) কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের হায়দ্রাবাদনগর সীমান্তে মাদক কারবারিদের গুলিতে মহিউদ্দিন সরকার নাইম নিহত হন। ওইদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) মহিউদ্দিন সরকার নাইমের মা নাজমা আক্তার বাদী হয়ে ৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ৬ জনকে আসামি করে বুড়িচং থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়, কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর এলাকার সাদেক মিয়ার ছেলে মো. রাজুকে (২৪)।
রাজু পরবর্তীতে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। মামলার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে দুইজন ছিল এজাহার নামীয়। বাকি দুই আসামি অজ্ঞাতনামা।
গ্রেপ্তারকৃত এজহার নামীয় আসামিরা হলো-মো. ফরহাদ মৃধা (৩৮) ও মো. পলাশ মিয়া (৩৪)।
বুড়িচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, “মহিউদ্দিন হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত চারজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।”
ক্রসফায়ারে যা ঘটেছিল
গত শনিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের গোলাবাড়ি এলাকায় এই ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে।
র্যাব-১১ ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি-২ কুমিল্লার অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, শনিবার রাতে র্যাবের সদস্যরা চোরাচালানবিরোধী অভিযান চালাতে গোলাবাড়ি এলাকায় যান। তখন র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। একই সঙ্গে হামলা চালানো হয়। এ সময় র্যাবও আত্মরক্ষার্থে ও সরকারি সম্পদ রক্ষায় পাল্টা গুলি করে।
মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, ওই বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থলে এক ব্যক্তিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। এ সময় সেখান থেকে একটি পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়। দ্রুত তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি জানান, এ ঘটনায় র্যাবের এক সদস্য আহত হয়েছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১১
আপনার মতামত জানানঃ