২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সামরিক বাহিনীর সহিংসতার শিকার হন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। তাদের নিধনে চালানো হয় গণহত্যা। জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। তখন থেকে নানা ভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা তথা গণহত্যার কথা স্বীকার করলেন দেশটির সেনাবাহিনীর এক দলত্যাগী ক্যাপ্টেন।
দলত্যাগীর নাম নায় মিয়ো থেট। গত ৬ বছর ধরে রাখাইনে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনি পালিয়ে যান এবং জান্তা-বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে আশ্রয় নেন।
সেখানে এসেই তিনি গণহত্যার বিষয়টি স্বীকার করেন। একইসঙ্গে এ নিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। এ খবর দিয়েছে মার্কিন সরকারের অর্থায়নে চালিত গণমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়া (আরএফএ)।
২০১৬ সালে রাখাইনে বড় মাত্রায় অভিযান চালানো শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে ওই বছরই ৯০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১৭ সালে অভিযান তীব্র করা হলে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে বাংলাদেশ সীমান্তে।
ওই বছর ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আরএফএকে মিয়ো থেট জানিয়েছেন, সেনারা রাখাইনে যা করেছে তাতে সেখানে ‘গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে’। হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে মামলা চলছে তাতে সাক্ষ্য দেয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড তুলে ধরে মিয়ো থেট জানান, ২০০৬ সালে মিয়ানমারের পিন-ও-লুইন একাডেমিতে যোগ দেন তিনি। এরপর ২০০৮ সালে সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। প্রথম দিকে তাকে কায়িন ও কাচিন রাজ্যে মোতায়েন করা হয়। তাকে রাখাইনে পাঠানো হয় ২০১৫ সালে, ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সেখানেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মিয়ো থেট জানান, ২০১৬ সালে একটি সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে প্রথম অভিযান শুরু করেন তারা। ২০১৭ সালে আরসা’র আরেক হামলার পর বড় অভিযান চালানো হয়। আমরা অভিযানে গিয়ে দেখি, সেখানে কিছুই আর বাকি নেই। স্থানীয়রা প্রায় সবকিছুই নিয়ে চলে গেছে।
সেনারা রাখাইনে যা করেছে তাতে সেখানে ‘গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে’
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছেন মিয়ো থেট। তিনি বলেন, এক অভিযানে সেনারা গ্রামগুলোতে ছুরি বা এ ধরণের অস্ত্র খুঁজতে অভিযান চালিয়েছিল। সেখানে এক সেনা কর্মকর্তা রোহিঙ্গা মেয়েদের নগ্ন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে আরেক সদস্যের কাছ থেকে আমি জানতে পারি, তার এক সহকর্মী রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করেছে। তবে তার নাম আমার এখন মনে নেই। এছাড়া, একটি ছোট ছেলেকে কুয়ার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। আস্তে আস্তে নির্মম সব ঘটনা আমার কানে আসতে থাকে। গ্রামবাসীকে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং যারা দৌড়ে পালায় তাদেরকে গুলি করে মারা হয়। বেশিরভাগ মরদেহকে তাদের গ্রামের কাছেই কবর দেয়া হয়েছে।
মিয়ো থেট বলেন, রাখাইনে যা হয়েছে, তা হওয়া উচিৎ ছিল না। এগুলো ছিল অগ্রহণযোগ্য। আমি আমার সহকর্মীদের এ কথা বলেছিলাম। কিন্তু তারা বিশ্বাস করতো, রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ যারা সন্ত্রাসী হামলা করেছে তাদেরকে সমর্থন দেয় এই রোহিঙ্গারা। তাই তাদেরকে তাড়িয়ে না দেয়া পর্যন্ত শান্তি আসবে না। অর্থাৎ, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পুরো একটি জাতিগোষ্ঠীকে বিতারিত করার ইচ্ছা পোষণ করতো। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার যে আন্তর্জাতিক অভিযোগ রয়েছে তাকে সমর্থন করেন বলেও জানান মিয়ো থেট।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা হয়েছে তার জন্য মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচি দায়ি নয় বলেই মনে করেন সাবেক এই সেনা সদস্য। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী একজন বলির পাঁঠা খুঁজছিল। তাই তারা এনএলডিকে (সুচির দল) ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। তবে অং সান সুচি আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েছিলেন মূলত দুটি উদ্দেশ্যে। প্রথম তিনি জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয়ত তিনি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেকে দায়গ্রস্থ মনে করেছিলেন।
কিন্তু মিয়ো থেট বিশ্বাস করেন, এই গণহত্যার জন্য সুচিকে দায়ি করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, সুচির মোটেও হেগে যাওয়া উচিৎ হয়নি। কারণ, যা হয়েছে তার জন্য তিনি দায়ি ছিলেন না। তিনি কোনো অপরাধ করেননি। সামরিক বাহিনীই রাখাইনের বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভেদ তৈরির জন্য দায়ি। তারাই এই বিদ্বেষের বীজ বপন করেছে। আমাকে যদি আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালতে ডাকা হয়, আমি সেখানে যাব এবং যা যা জানি সব প্রকাশ্যে নিয়ে আসবো।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ২০ মার্চ আরাকানের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর ২০১৭ সালে পরিচালিত সেনা অভিযানকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, সেসময় মিয়ানমার সরকার আরাকান রাজ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাসরত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব চূড়ান্তভাবে বাতিল ঘোষণা করে। একই সঙ্গে ১২ লক্ষাধিক বেসামরিক মানুষের ওপর নির্বিচারে ধর্ষণ, লুণ্ঠন, বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং হত্যাকাণ্ডের মতো বর্বরোচিত হামলা চালায় খোদ সেনাবাহিনী।
নিজ দেশের সশস্ত্র বাহিনীর অত্যাচার থেকে প্রাণে বাঁচতে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী ভিড় জমান প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সীমান্তে। বিশ্বের সপ্তম ঘনবসতিপূর্ণ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের পক্ষে এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর দায়িত্ব গ্রহণ করাটা ছিল মারাত্মক চ্যালেঞ্জের বিষয়। তথাপি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্রেফ মানবিক বিবেচনায় নিপীড়িত মানুষের জন্য সীমান্ত খুলে দেন। এ ঘটনার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের নিয়মিত আসর বসেছে অন্তত পাঁচবার। পৃথিবীর বহু দেশে নিপীড়িত নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মোতায়েন করা হয়েছে হাজার হাজার শান্তিরক্ষী। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে বেশকিছু সন্ত্রাসী সংগঠন ও সন্ত্রাসের মদদদাতা দেশের তালিকা।
কিন্তু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমার সরকারের গণহত্যার বিচার (আন্তর্জাতিক আদালতে উগান্ডার দায়েরকৃত মামলা ব্যতীত) এবং মাতৃভূমি থেকে বলপূর্বক বিতাড়িত মিয়ানমারের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনা অভিযানকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টাকে কোনো কোনো মহল বৈশ্বিক মানবাধিকার সংরক্ষণের পথে একটি মাইলফলক হিসাবে উপস্থাপন করছেন।
এ বাস্তবতায়, আরাকান ও ফিলিস্তিনের মতো বহুদশক ধরে নিপীড়নের শিকার জনপদগুলোর প্রসঙ্গটা আবারও বিশ্ববাসীর সামনে চলে আসে। কেন জাতিসংঘ বা মানবাধিকার সংরক্ষকের দাবিদার রাষ্ট্রগুলো এ জনপদগুলোয় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তৎপর হচ্ছে না? এর পেছনে কি কেবল আধিপত্য বিস্তার বা করপোরেট স্বার্থই মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে? নাকি বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে কোনো অদৃশ্য চলক? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পেতে হবে বিশ্বজুড়ে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ থেকেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৩
আপনার মতামত জানানঃ