হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গরমের সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। ঢাকার আশপাশের জেলাতেও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। ডায়রিয়া রোগী কমার কোনো আভাস নেই।
সারাদেশে এ বছর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় তিন লাখেরও বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় মহাখালীতে আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি) ভর্তি হন ৯,২৩৩ জন রোগী। শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত একদিনে ৯৯৭ জন নতুন রোগী ভর্তি হন এই হাসপাতালে।
আইসিডিডিআর,বি-এর গণসংযোগ বিভাগ জানায়, সারা বছরই ডায়রিয়া হয়। তবে এ বছরের মার্চ মাস থেকে এর প্রকোপ বেড়ে গেছে। মার্চ থেকে এ পর্যন্ত আইসিডিডিআর,বিতে ৪৩ হাজারেরও বেশি ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হন। এর মধ্যে মার্চ মাসে ভর্তি হন ৩০ হাজার ৫০০। আর চলতি মাসে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৩০০’র বেশি রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ৮ এপ্রিল ভর্তি হন এক হাজার ৩৮২ জন। এখন প্রতি ঘণ্টায় ওই হাসপাতালে প্রায় ৬০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
কলেরা হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম সংবাদমাধ্যমকে জানান, ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়ার পর হাসপাতালের সামনে দুইটি আলাদা তাঁবু করা হয়েছে। দুইটি তাঁবুতে মোট শয্যা ১৫০টি। আর হাসপাতালে আছে ৪৫০টি। আরও কিছু রোগীকে অতিরিক্ত বেড করে জায়গা দেওয়া হচ্ছে। এখন হাসপাতালে সার্বক্ষণিকভাবে কমপক্ষে ৬৫০ জন ডায়রিয়া রোগি ভর্তি থাকছেন।
তিনি বলেন, ‘‘প্রতি দিন এক হাজার ৩০০-এর বেশি রোগী এলেও সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়ে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা অনেক রোগীকে ফ্লুইড দিয়ে ‘স্ট্যাবল’ করে ফেলি। এরপর চিকিৎসাপত্র দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিই। আর যাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে তারাও চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান। তবে এখন আমরা রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি।’
গতকাল শুক্রবার ঢাকার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ৫৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮৮ জন ভর্তি হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এ হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাহারুল আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালেও ডায়রিয়া রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বেশি চাপ আমাদের হাসপাতালে। ’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বশেষ ১৮ ঘণ্টায় আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে এক হাজার ৪৮ জন রোগী ভর্তি হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার এক হাজার ৩৮২ জন, বুধবার এক হাজার ৩৭০, মঙ্গলবার এক হাজার ৩৭৯, সোমবার এক হাজার ৩৮৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়রিয়ার সঙ্গে কলেরায় আক্রান্ত রোগীও ভর্তি হচ্ছে।
ডা. বাহারুল আলম বলেন, গত ৮ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত যেসব রোগী ভর্তি হয়েছিল তাদের মধ্যে ২৩ শতাংশ কলেরায় আক্রান্ত ছিল। তিনি বলেন, ‘গরমের সময় প্রতিবছরই আমাদের এখানে ভর্তি রোগীদের ২০ শতাংশের মতো কলেরায় আক্রান্ত অবস্থায় ভর্তি হয়। তবে এতে উদ্বেগের কিছু নেই। কলেরার চিকিৎসা আছে এবং এ রোগ আগের মতো জীবনঘাতী নয়। দেশে কলেরার ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও তার সফল প্রয়োগ হয়েছে। ’
এবার কেন এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো?
বাংলাদেশে প্রতি বছরই গরমকালে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। এই বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে এবং মার্চের মাঝামাঝি থেকে বেশ ব্যাপকহারে তা বাড়তে শুরু করেছে।
সাধারণত প্রতি বছর এর প্রকোপ শুরু হয় এপ্রিলের শুরু থেকে এবং ছয় থেকে আট সপ্তাহ তা চলতে থাকে। কিন্তু এই বছর ডায়রিয়া যে শুধু আগেভাগেই শুরু হয়েছে তাই নয়, রোগীর সংখ্যাও আগের যেকোনো বছরের চাইতে অনেক বেশি।
এই সপ্তাহের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
তবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বছর গরম একটু আগেই শুরু হয়েছে এবং এর সাথে করোনাভাইরাস বিষয়ক স্বাস্থ্যবিধি পুরো শিথিল হয়ে যাওয়ার সম্পর্ক দেখছেন তারা।
বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ৫৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮৮ জন ভর্তি হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
তারা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল, মানুষজনের চলাচল ও জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে, প্রচুর মানুষ ঢাকার বাইরে চলে গিয়েছিলেন।
‘অনেক কিছু ধীরে ধীরে খুলেছে। কিন্তু এখন সবকিছু একদম পুরো চালু হয়ে গেছে। সব মানুষ একসাথে বের হয়েছে। সেই সাথে মার্চেই আমরা ৩৪, ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠতে দেখেছি। এই ধরনের তাপমাত্রায় খাবারে দ্রুত জীবাণু জন্ম নেয়। কোন সময়ের পর আর খাবার খাওয়া উচিত না— সেটা মানুষ বুঝতে চায় না’।
‘আর রাস্তার খাবার, লেবুর শরবত—এসব প্রাপ্ত বয়স্কদের ডায়রিয়ার জীবাণুগুলোর অন্যতম উৎস। সবাই একসাথে এসব খাচ্ছে এবং রোগটি ছড়াচ্ছে’।
এছাড়া তারা মনে করেন, গত দুই বছর মানুষজন নানা ধরনের স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে ছিল। হাত পরিষ্কারের প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসা এবং স্বাস্থ্যবিধি শিথিল হওয়ার সাথে সাথে মানুষজনের ঘনঘন হাত ধোয়া এবং জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার করার প্রবণতা কমে আসছে।
ডায়রিয়া প্রতিরোধে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি হচ্ছে খাবার প্রস্তুত, স্পর্শ করা, পরিবেশন করা ও খাবার খাওয়ার আগে, টয়লেট থেকে বের হয়ে, বাইরে থেকে ফিরে এসে হাত ধুয়ে নেয়া। কারণ হাত দিয়েই মানুষ সবকিছু স্পর্শ করে এবং সবচেয়ে বেশি জীবাণু বহন করে।
ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হচ্ছে পানি। ঢাকার যেসব এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে সেখানে কলের পানিতে সমস্যা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকায় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মূলত উৎসে পানির মান পরীক্ষা করে। কিন্তু প্রচুর এলাকায় পানির পাইপ ফুটো হয়ে সুয়ারেজ লাইনের সাথে মিশে গেছে এবং এই সমস্যা সারা বছরের।
এই সময়ে বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং পঁচা-বাসি খাবার খেয়েই বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানান আইসিডিডিআর,বি-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন গরম ও বাতাসে আর্দ্রতা আছে। তাই খাবারে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়, এটাও ডায়রিয়ার কারণ।’
তিনি বলেন, ‘‘ঢাকায় এমনিতেই এখন পানির সংকট চলছে। আবার গ্যাসের সংকট থাকায় ঠিক সময়ে রান্না-বান্না করা যাচ্ছে না। ফলে অনেকেই দূষিত পানি পান এবং পঁচা- বাসি খাবার খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।’
তিনি জানান, সাধারণত শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় বেশি। কিন্তু এবার প্রাপ্তবয়স্করা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এর কারণ তারা নানা কাজে বাইরে থাকছেন। বিশেষ করে যারা নিম্নবিত্ত তারা এই গরমে বাইরের দূষিত পানি এবং শরবত বা জুস খাচ্ছেন। নিম্নবিত্ত মানুষই আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। তারা রাস্তার পাশে কাজ করেন, কেউ রিকশা চলান। এই গরমে তারা যা পাচ্ছেন তাই খাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
ডা. মো. ইকবাল হোসেন সবাইকে পানিয়ে ফুটিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দেন। আর সেটা যে পরিমাণ পানি হোক না কেন বলক ওঠার পর আরও পাঁচ-সাত মিনিট ফুটাতে হবে বলে জানান তিনি।
আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে প্রথমেই হাসপাতালে না গিয়ে খাবার স্যালাইন নিয়ম মেনে খাবার পরামর্শ দেন। যদি বেশি বেশি বমি হয়, চোখ মুখ শুকিয়ে যায়, অবসাদ লাগে তাহলে দ্রুত কাছের হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর এই সময়ে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। এবার একটু বেশি, তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। টয়লেট শেষে ঠিকমতো হাত ধুতে হবে। এটা পানিবাহিত রোগ, তাই বিশুদ্ধ পানি যেভাবেই হোক ব্যবহার করতে হবে।’
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশের সব বিভাগ ও জেলায়ই ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। তবে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি। তাদের হিসাবে ঢাকায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখেরও বেশি মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক কারণেই বেশকিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা প্রহণের প্রয়োজন পড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় কিছু নেই, তবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ডায়রিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার মধ্যে পানি ফুটিয়ে পান করা অন্যতম। এ ছাড়া ডায়রিয়া হলে স্যালাইন ও অন্যান্য তরল খাবার, যেমন ডাবের পানি, চিড়া ভিজিয়ে তার পানি, ডালের পানি, ভাতের মাড়, চালের গুঁড়ার জাউ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। রাস্তার পাশের খোলা খাবার বা শরবতজাতীয় পানীয় পরিহার করতে হবে। যে কোনো খাবার গ্রহণের আগে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করাও ডায়রিয়া প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে বৃদ্ধ ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধসহ অন্যান্য খাবার তাদের যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়ানোই সমীচীন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১১
আপনার মতামত জানানঃ