হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গরমের সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। ঢাকার আশপাশের জেলাতেও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। ঘণ্টায় ৫০ জনের বেশি রোগী আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মহাখালী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, রোগীদের সিংহভাগই বয়সে তরুণ। তারা তীব্র পানিশূন্যতা সহ বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালটিতে আসছেন।
সূত্র জানিয়েছে, আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে গত সাত দিনে ৮ হাজার ১৫২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগে, ২০১৮ সালের এপ্রিলে ডায়রিয়ার এ রকম প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। মহামারির মতো রূপ ধারণ করে ওই বছরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।
২০০৭ এবং ২০১৮-এর পরে এবারই এত রোগী ভর্তি হলো। অর্থাৎ গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু আগেই দেশে ডায়রিয়ার ভয়াবহ প্রকোপ শুরু হয়েছে। আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালপ্রধান ডা. বাহারুল আলম বলেন, প্রতিবছরই শুষ্ক মৌসুমে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়।
তবে এবার সময়ের কিছুটা আগেই রোগী আসতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে রোগের জীবাণুর ধরন পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। তবে সেটি গবেষণা না করে বা নিশ্চিত না হয়ে বলা সম্ভব নয়। এবারের রোগীদের মধ্যে সিভিয়ার ডায়রিয়া এবং কলেরা আক্রান্ত রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। কলেরায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিগত সময়ের তুলনায় অনেক বেশি, যা মোট আক্রান্তের ২৩ শতাংশ।
আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসপাতালটিতে ডায়রিয়া রোগীর ব্যাপক চাপ রয়েছে। এত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন আইসিডিডিআরবির চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তবে সব চিকিৎসা হচ্ছে বিনা মূল্যে।
হাসপাতালের শয্যার চেয়ে ডায়রিয়া রোগী বেশি। তাই রোগীদের জায়গা দিতে আগেই বাইরে একটি তাঁবু টানিয়ে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা দিয়ে আসছিল আইসিডিডিআরবি। এখন বাইরে আরও একটি তাঁবু টানিয়ে হাসপাতাল বড় করা হয়েছে।
আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে গত সাত দিনে ৮ হাজার ১৫২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগে, ২০১৮ সালের এপ্রিলে ডায়রিয়ার এ রকম প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। মহামারির মতো রূপ ধারণ করে ওই বছরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।
ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আইসিডিডিআরবি বলছে, প্রতিষ্ঠানের ৬০ বছরের ইতিহাসে এত রোগীর চাপ তারা দেখেনি।
আইসিডিডিআরবি সূত্র বলছে, সারা বছর দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ ডায়রিয়া রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে রোগীর সংখ্যা কিছু বাড়ে। সাধারণত মার্চের শেষ সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শেষ সপ্তাহে রোগী চূড়ান্তভাবে বাড়ে। কিন্তু এ বছর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে।
আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষ জানায়, চলতি মার্চের প্রথম সপ্তাহে দৈনিক পাঁচ শয়ের মতো রোগী আসে। দ্বিতীয় সপ্তাহে দৈনিক রোগী বেড়ে হয় ছয় শ। ১৭ মার্চ থেকে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়। ২১ মার্চ রোগী ভর্তি হয়েছিল ১ হাজার ২১৬ জন। ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, চলমান তাপদাহের কারণে আমাদের শরীরে পানির চাহিদা বেড়েছে। তৃষ্ণা মেটাতে খোলা জায়গায় শরবত ও আখের রস পান করছেন অনেকেই। নোংরা পরিবেশে তৈরি করা এসব পানীয়তে ব্যবহার হচ্ছে দূষিত পানি। এসব পান করার ফলেই তরুণদের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
তরুণদের মধ্যে এ বছর ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি। এ বিষয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিবছরই এই মৌসুমে গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়রিয়া রোগী বাড়ে। গত বছর কোভিডের লকডাউনের কারণে মানুষ বাইরে বের হয়নি। তাই বাইরের দূষিত খাবার না খাওয়ায় ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক ছিল। তবে এবার রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
আইসিডিডিআর,বির সহযোগী গবেষক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. লুবাবা শাহরিন জাগো নিউজকে বলেন, খাবার ও পানির মাধ্যমে ডায়ারিয়ার জীবাণু সংক্রমিত হয়। গরম বাড়ার কারণে খোলা জায়গার বিভিন্ন ফলের জুস, শরবত খাচ্ছেন পথচারীরা। এই কারণে ডায়ারিয়ার বিস্তারটা এবার ব্যাপক।
তিনি বলেন, মার্চের শুরু থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ১৪ মার্চ থেকে দৈনিক এক হাজারের বেশি রোগী আসছেন। গত কয়েক বছরে এতো রোগী আমরা দেখিনি। এবার ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের তুলনায় তরুণ রোগী বেশি পাচ্ছি।
তরুণ রোগী বাড়ার কারণ হিসেবে ডা. লুবাবা শাহরিন বলেন, তারা হয়তো বাইরের খাবার বেশি খাচ্ছেন। খোলা জায়গার বা মুক্ত পরিবেশের খাবার খাচ্ছেন। এ কারণে ডায়রিয়ার মতো পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, এবার অনেক বেশি মাত্রায় রোগী পাচ্ছি। রোগীরা মারাত্মক পানিশূন্যতা নিয়ে আমাদের কাছে আসছেন। তারা সঠিক সময়ে যদি না আসতেন তাহলে অনেকের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতো। ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ পানি ও খাবারের বিকল্প নাই। সবচেয়ে ভালো ঘরে তৈরি করা খাবার ও ফুটানো পানি খেতে হবে। পাশাপাশি বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
ডায়রিয়ার চিকিৎসা বিনামূল্যে হওয়ায় আক্রান্তরা সাধারণত আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে বেশি আসেন। তাই এখানে রোগীর চাপও বেশি থাকে। রোগীর চাপ সামলাতে এবার হাসপাতালের বাইরে টানানো হয়েছে অস্থায়ী তাবু। সেখানে শতাধিক বিছানাও বসানো হয়েছে।
ডা. লুবাবা শাহরিন বলেন, আমরা কোনো রোগীকে ফেরত দিচ্ছি না। যারা মারাত্মক পানিশূন্যতা নিয়ে আসছেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। এতে তারা দ্রুতই সুস্থ হচ্ছেন। আমাদের জায়গা স্বল্পতার কারণে কোনো রোগী মোটামুটি সুস্থ হলেই বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। কারণ আরও অনেক রোগী ভর্তির জন্য আসছেন।
যখন বুঝতে পারি রোগী ঝুঁকিমুক্ত, তাদের কাউন্সিলিং করে ওষুধ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপরও আমরা বলে দিচ্ছি রোগীরা কী কী নিয়ম মেনে চলবেন, কীভাবে সুস্থ থাকবেন বা কী হলে আবার হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। এই সাজেশনগুলো দিয়ে রোগীদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণত রোগীরা একদিন থাকার পরই বাসায় যেতে পারছেন, যোগ করেন আইসিডিডিআর,বির এই সহযোগী গবেষক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক কারণেই বেশকিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা প্রহণের প্রয়োজন পড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় কিছু নেই, তবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ডায়রিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার মধ্যে পানি ফুটিয়ে পান করা অন্যতম। এ ছাড়া ডায়রিয়া হলে স্যালাইন ও অন্যান্য তরল খাবার, যেমন ডাবের পানি, চিড়া ভিজিয়ে তার পানি, ডালের পানি, ভাতের মাড়, চালের গুঁড়ার জাউ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। রাস্তার পাশের খোলা খাবার বা শরবতজাতীয় পানীয় পরিহার করতে হবে। যে কোনো খাবার গ্রহণের আগে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করাও ডায়রিয়া প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে বৃদ্ধ ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধসহ অন্যান্য খাবার তাদের যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়ানোই সমীচীন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪১
আপনার মতামত জানানঃ