ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে সক্রিয়া উগ্রবাদী জঙ্গিরা। দিন দিন তাদের তৎপরতা বেড়েই চলছে। ভার্চুয়াল মাধ্যমে জঙ্গিরা মেধাবী তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করে। তারা তাদেরকে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের টোপ গেলায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতেও থামানো যাচ্ছে না এদের তৎপরতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের এক কৌশল জানার পর তারা ভিন্ন কৌশলে চালায় সাংগঠনিক কার্যকম। এরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে কলেজ ও মাদ্রাসা ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে টার্গেট করে টোপ দিচ্ছে। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কৌশলে জঙ্গিবাদে ভিড়িয়ে দলে ভেড়াচ্ছে। এরপর রীতিমতো হিংস্র করে তুলছে।
দেশে প্রতিদিন গড়ে একজনেরও বেশি উগ্রবাদী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার হয়। যারা মানসিকভাবে কট্টর মৌলবাদী ও আক্রমণত্মক এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের কর্মী। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় উগ্রবাদে উসকানিমূলক বই, দেশীয় অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনও ঘটনা ঘটলে এসব উগ্রবাদী ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও সরব হয়ে ওঠে। তাদের মতাদর্শ ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো এ সময় তাদের সমমনা ব্যক্তিদের টার্গেট করে বিভিন্ন কৌশলে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে।
বাংলাট্রিবিউনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ মোকাবিলায় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) কাজ করছে। এসব ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্রবাদী বা জঙ্গি সংগঠনগুলোর ৪২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে শীর্ষ জঙ্গি নেতারাও রয়েছে। এই হিসাব অনুযায়ী গড়ে প্রতি মাসে ৩৫ জন এবং প্রতিদিন ১ জনেরও বেশি উগ্রবাদী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ২০২১ সালে ৩০টি অভিযানে ৪৬ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে– ‘জেএমবি’র সাত জন, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি)’ ২১ জন, ‘আল্লাহর দলের’ পাঁচ জন, ‘হিযবুত তাহরীরের’ তিন জন ও ‘আনসার আল ইসলামের’ ১০ জন। তবে তাদের কাছ থেকে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র বা দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
দেশে এই উগ্রতার নেপথ্যে সব ধর্মের অপব্যাখ্যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘যে যার মতো করে ছড়িয়ে দিচ্ছে’ বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সাধারণ মানুষ এখন কোনও ঘটনার সংবাদের সূত্র জানতে যায় না, যাচাই-বাছাই করে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য-মিথ্যা যা পায় সেটাকেই ধারণ করছে। আবার সেগুলো যদি ধর্মীয় লেবাসধারীর মাধ্যমে প্রচারিত হয়, তাহলে বিশ্বস্ততা আরও বেড়ে যায়।
দেশে প্রতিদিন গড়ে একজনেরও বেশি উগ্রবাদী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার হয়। যারা মানসিকভাবে কট্টর মৌলবাদী ও আক্রমণত্মক এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের কর্মী।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে জঙ্গি দমনে ভূমিকা রেখেছে। ডিএমপির এই বিভাগ ২০২১ সালে বিভিন্ন সংগঠনের ৮৫ জন উগ্রবাদী বা জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। ৪১টি মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাদের কাছ থেকে এসময় ২টি বিদেশি পিস্তল, ৮ রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন, ২টি চাপাতি, ৪টি ছোরা, ১০টি ডেটোনেটর, অ্যাসিড ৫ লিটার, বিস্ফোরক পদার্থ ৬৩০ গ্রাম, ১৭৯টি জঙ্গিবাদী লিফলেট ও ৯৩টি বই উদ্ধার করা হয়।
নেট দুনিয়ায় তরুণদের আকৃষ্ট করতে ও প্রচারের জন্য উগ্রবাদীদের অসংখ্য আইপি, ওয়েবসাইট, ফোরাম, ব্লগ ও বার্তা চ্যানেল রয়েছে। চক্রটি এসব ব্লগের মাধ্যমে জিহাদ ও তাদের মতাদর্শের শাসনের কথা প্রচার করে। এসব চরমপন্থী গোষ্ঠীর নিজস্ব আইপি’ও (ইন্টারনেট প্রটোকল) আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গিদের বেশ কিছু এক্সপার্ট গ্রুপ অনলাইনে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনায় সক্রিয় রয়েছে। এরা আইটি বিষয়ে অনেক বেশি পারদর্শী। এরা ইন্টারনেটে বিভিন্ন নামে ওয়েবসাইট-ব্লগ খুলে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিবাদের প্রচারণা চালাচ্ছে।
তারা বলেন, ভার্চুয়াল মাধ্যমে জঙ্গিরা মূলত মেধাবী তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করে। এরা ছয় ধরনের তরুণ-তরুণীকে টোপ দেয়। পরিবারের সঙ্গে যাদের দূরত্ব থাকে, যারা অতিরিক্ত স্বাধীন, বিভিন্ন কারণে যাদের মধ্যে হতাশা প্রকাশ পায়, অনলাইন মাধ্যম ছাড়া যাদের বিনোদনের তেমন কোনো মাধ্যম নেই এবং ধর্ম সম্পর্কে যাদের জ্ঞান নেই- এমন তরুণ-তরুণীকে তারা টোপ দেয়। এরপর সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ‘মগজ ধোলাই’ করে তাদেরকে দলে ভেড়ায়।
তারা বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আপনি সাইট বন্ধ করবেন, ওরা আবার নতুন সাইট চালু করবে। আমাদের আইটি প্রশিক্ষণ আরও বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের থেকে এক ডিগ্রি এগিয়ে থাকতে হবে।
তাদের মত হচ্ছে, দেশে প্রচলিত যে আইন আছে, সেটা ঠিকমতো বাস্তবায়ন করলে আর কিছুই লাগে না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা করা হয় না। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আড়ি পাতার নামে যা হয়, তা অনেকটাই শিশুসুলভ কাজ।
গত কয়েক বছরে ব্লগার, লেখক-প্রকাশকসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে ফেসবুক ও টুইটারে। হত্যার পর দায় স্বীকারের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম৷ গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের হত্যার কথা জঙ্গিরা ওই রাতেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ করে৷
বিশ্লেষকরা বলেন, অনলাইন জগতের নিয়ন্ত্রণ নিতে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা বিনিয়োগ করছে। এসব ঠেকাতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনেক তৎপর হতে হবে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০২
আপনার মতামত জানানঃ