জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর আধুনিক ও সভ্য বিশ্বে মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বুধবার(৩০ মার্চ) এ কথা জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেন, সিরিয়া, মিয়ানমার, সুদান ও হাইতির পাশাপাশি সংঘাত ছড়িয়েছে ইউক্রেনে।
জাতিসংঘের শান্তি কমিশনের দেয়া তথ্য মতে, গত বছর বিশ্বে সংঘর্ষ, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ৮ কোটি ৪০ লাখ মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
বিশ্বসংঘটির শান্তি কমিশনের উদ্দেশে মহাসচিব বলেন, ‘সংস্থাটি ইউক্রেন যুদ্ধে দেশ ছাড়া ৪০ লাখ ও দেশের মধ্যে বাস্তুচ্যুত ৬৫ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর বিশ্বে কমপক্ষে ২৭ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্যে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন হয়ে উঠেছে।’
এর সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। বাস্তুচ্যুত ও উদ্বাস্তুদের সহায়তা হিসেবে ১৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে দিতে খরচ পড়বে ৪১০ কোটি ডলার।
গুতেরেস রেকর্ড ২০০ কোটি মানুষের ঘর ছাড়া হবার প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেন, ‘বিশ্বে সর্বোচ্চ ৫৬টি দেশে ২০২০ সালে সংঘাতময় পরিবেশ বিরাজমান ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় মৃত্যুসহ বিভিন্ন ঝুঁকির পরিমাণও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। অর্থনৈতিক বৈষম্য, করোনারোধে সমন্বিত ব্যবস্থা ও জলবায়ু পরিবর্তন এসবের মধ্যে অন্যতম।’
ইউক্রেনে সংঘাত চলছেই। দেশটিতে রাশিয়ার হামলা অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। দেশ ছেড়ে লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে গেছে। খাদ্য, পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। যুদ্ধ না থামলে পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার ধারণ করতে পারে।
ইতিমধ্যেই যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় এক প্রকার অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের অর্থনীতি। ধ্বংস হয়ে পড়েছে দেশটির বিভিন্ন অবকাঠামো। বন্ধ হয়ে গিয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সাধারণ নাগরিকরা মৌলিক সেবাগুলোও পাচ্ছে না।
গত বছর বিশ্বে সংঘর্ষ, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ৮ কোটি ৪০ লাখ মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
জাতিসংঘের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী বছরের মধ্যে দেশটির গত দুই দশকের যাবতীয় অগ্রগতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দারিদ্র্যে পতিত হবে দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বিষয়ক সংস্থা (ইউএনডিপি) সতর্ক করে জানিয়েছে, ইউক্রেনের চলমান সংঘাত যদি থামানো না যায়, তবে এই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হবে।
ইউএনডিপি’র পরিচালক আচিম স্টেইনার আল জাজিরাকে বলেন, আমরা দেখছি যে, পুরো ইউক্রেন জুড়েই মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে।
যুদ্ধ মানে শুধুই যুদ্ধরত দেশের মানুষের ক্ষতি এমন নয়। কোথাও যুদ্ধ বাধলে সেই প্রভাব গিয়ে পড়তে পারে হাজার মাইল দূরের কোনো দেশের মানুষের উপরও। চলমান ইউক্রেন রাশিয়া সংঘাত নিয়ে এমন নানা সংকটের সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও জ্বালানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এ কারণে অন্তত ৪ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়বে বলে সতর্ক করেছে সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) নামের একটি থিংকট্যাংক।
বিশ্বের ২৯ শতাংশ গম উৎপাদিত হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনে। এই বিশ্বের ৬ ভাগের ১ ভাগ সার আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে কৃষি বাণিজ্যের জন্য প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চল কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন থিংকট্যাংক বলছে, যুদ্ধের ধাক্কা শুধু এই অঞ্চলেই নয়, সারা বিশ্বেই ব্যাপকভাবে অনুভূত হবে। এটি সবচেয়ে বেশি আঘাত করবে দরিদ্র দেশগুলোকে।
এর আগে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলি বলেছিলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম এতটাই বেড়ে যাবে যে, তা বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
বিবিসি অপর এক প্রতিবেদন বলেছে, গত চার বছরে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৮ কোটি থেকে বেড়ে ২৭ কোটি ৭৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। নানা রকম যুদ্ধ-সংঘাত, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং করোনাভাইরাস মহামারি—সব মিলিয়ে একটা ভয়ংকর দুর্যোগ তৈরি হয়েছে।
শুধু খাদ্য ও জ্বালানি নয় আরো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যার অন্যতম কারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ। মার্কিন মুলক ও ইউরোপ থেকে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আসছে রাশিয়ার উপর। আবার কে কার পক্ষে কথা বলেছে বা বলেনি কিংবা চুপ থেকেছে তার উপর নির্ভর করে পরিবর্তন হচ্ছে পূর্বে করা আমদানি রফতানি চুক্তি। ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা ও সৈন্য প্রত্যাহারে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রেজ্যুলেশনের পক্ষে ভোট না দেয়ায় বাংলাদেশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ভ্যাকসিন না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে লিথুয়ানিয়া।
সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়, যাতে অনতিবিলম্বে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। ওই রেজ্যুলেশন বিষয়ে জাতিসংঘে দুইদিন উন্মুক্ত আলোচনা এবং বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলোচনায় জাতিসংঘে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত রাশিয়াকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে প্রত্যক্ষ ভোটে জাতিসংঘে ওই রেজ্যুলেশন পাস হয়। এমন আরো কতো নিত্য নতুন সমস্যায় পরতে হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৩
আপনার মতামত জানানঃ