ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী লেখম মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অনেকেরই অভিযোগ এ আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়রানির এবং অপব্যহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসবের মধ্যেই প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
‘নড়াইল কণ্ঠ’ সাপ্তাহিক ও অনলাইনের প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে খুলনা বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলা হয়েছে। নড়াইল শহরের সারের ডিলার মো. হাসানুজ্জামান ২৩ মার্চ মামলাটি করেন। হাসানুজ্জামান নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও নড়াইল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাংবাদিক কাজী আনিচ, নড়াইল শহরের আলী মণ্ডল, খন্দকার শাহেদ আলী ও বাকিউল আজম। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ‘নড়াইল কণ্ঠ নিউজ’ নামের একটি ফেসবুক আইডিতে সারের ডিলার হাসানুজ্জামানের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অসত্য তথ্য প্রচার করে এক কোটি টাকার মানহানি করেছে।
এ বিষয়ে ‘নড়াইল কণ্ঠ’-এর সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অসত্য, বানোয়াট ও কাল্পনিক। হাসানুজ্জামানের বক্তব্য নিয়ে নিউজ প্রকাশ করা হয়েছে। আমি পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছি।’
কৃষক আলী মণ্ডলকে লাঞ্ছিতের অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নড়াইল শহরে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়। সমাবেশে সারের ডিলার হাসানুজ্জামানের বিচার ও তার ডিলারশিপ বাতিলের দাবি জানানো হয়। পরে একই দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। জেলা কৃষক লীগ এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
যে অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অসত্য, বানোয়াট ও কাল্পনিক। হাসানুজ্জামানের বক্তব্য নিয়ে নিউজ প্রকাশ করা হয়েছে। আমি পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছি।’
সম্প্রতি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আর্টিকেল নাইনটিনের’ এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১ মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর) ২২৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।
সরকারি দলের এসব নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ছাড়ারও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন, যাদের নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে।
এদিকে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম কর্মীরা আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই সরকার এমন আইন করেছে। তবে এসব অপরাধের বিচারে প্রচলিত আইনই যথেষ্ট।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে হত্যার আসামির দণ্ড মওকুফ হয় অথবা দ্রুত জামিন হয়, ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাত থেকে লুটপাটকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, হাজার-কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী সহজেই দেশ ছাড়তে পারে, কিন্তু ফেসবুকে সরকারবিরোধী কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে কিছু লেখা যেন তার চাইতে বড় অপরাধ!
তারা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে— এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
তারা বলেন, সারা বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী দেশ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২১৩
আপনার মতামত জানানঃ