গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানুষের তথ্য জানার অধিকার স্বীকৃত। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন পাস হয়। এতে তথ্যপ্রাপ্তি সহজ করা হয়। অনেকটা ‘চাহিবা মাত্র’ সরকারের কাছ থেকে যেকোনো বিষয়ে তথ্য পেতে পারেন নাগরিকরা। কিন্তু এ আইনের অনুশীলনে বিরাট ফাঁক রয়েছে। একজন মানবাধিকারকর্মী পুলিশের কাছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপারে তথ্য চেয়েছিলেন। তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। আইন অনুযায়ী পুলিশ কারো আবেদন এড়িয়ে যেতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ওই কর্মীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য সরবরাহ করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে তথ্য কমিশন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাসংক্রান্ত পরিসংখ্যান ২০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে সরবরাহ করতে বলেছিল তথ্য কমিশন। ৮ মার্চ এই নির্দেশনা দেয় কমিশন। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত এ–সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাননি মানবাধিকারকর্মী সাদ হাম্মাদি।
বাংলাদেশের নাগরিক সাদ হাম্মাদি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক অফিসে (শ্রীলঙ্কা) কর্মরত। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে আজকে পর্যন্ত কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি৷ কমিশনের কাছ থেকে এখনো সিদ্ধান্তপত্র পাওয়া যায়নি, ফলে তথ্য কবে নাগাদ পাওয়া যাবে, বুঝতে পারছি না৷’
দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মোট কত মামলা, কত আসামি এবং কতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার পরিসংখ্যান চেয়ে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে আবেদন করেছিলেন মানবাধিকারকর্মী সাদ হাম্মাদি। এসব তথ্য প্রকাশ পেলে আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে—এমন কারণ দেখিয়ে তথ্য দেয়নি পুলিশ।
পুলিশের কাছ থেকে তথ্য না পেয়ে আবেদনকারী সাদ হাম্মাদি অভিযোগ দায়ের করেন তথ্য কমিশনে। একাধিক দিন এই অভিযোগের শুনানি শেষে ৮ মার্চ আদেশ দেয় তথ্য কমিশন। আদেশে বলা হয়, অভিযোগকারী যেসব তথ্য চেয়েছেন, সেগুলো তথ্য অধিকার আইনে প্রদানযোগ্য। আগামী ২০ দিনের মধ্যে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে আবেদনকারীকে তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে কমিশন।
বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষে তথ্য কমিশনে শুনানিতে অংশ নিয়েছেন আইনজীবী তাইফুল সিরাজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য কমিশনের আদেশের বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত৷ কমিশন মৌখিক আদেশ দিয়েছে। লিখিত আদেশে বলা থাকবে কোন তারিখের মধ্যে তথ্য দিতে হবে৷
তথ্য কমিশনের গবেষণা কর্মকর্তা রাবেয়া হেনা এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সিদ্ধান্তপত্র স্বাক্ষরের কার্যক্রম চলছে৷ দুই পক্ষের কাছেই পত্রের কপি যাবে৷ কমিশনের ওয়েবসাইটেও সিদ্ধান্তপত্রটি পাওয়া যাবে। দ্রুতই সিদ্ধান্তপত্রটি প্রস্তুত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সিদ্ধান্তপত্র জারির দিন থেকে আদেশে উল্লেখিত ২০ দিন গণনা হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাসংক্রান্ত পরিসংখ্যান ২০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে সরবরাহ করতে বলেছিল তথ্য কমিশন। ৮ মার্চ এই নির্দেশনা দেয় কমিশন। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত এ–সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাননি মানবাধিকারকর্মী সাদ হাম্মাদি।
মানবাধিকারকর্মী সাদ হাম্মাদি ২০২১ সালের ৭ জুন পুলিশ সদর দফতরে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন। তার জানার বিষয় ছিল, দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মোট মামলা কত, আসামি কত এবং কতজন গ্রেপ্তার হয়েছে। তথ্য না পাওয়ায় গত ১৮ জুলাই পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর আপিল করেন। সেই আবেদন খারিজ করে একটি চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে আইনের কয়েকটি ধারা উল্লেখ করে বলা হয়, আবেদনকারীর তথ্য প্রকাশ করার মতো নয়। এসব তথ্য প্রকাশ পেলে আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, অপরাধ বাড়তে পারে, জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, বিচারাধীন মামলার সুষ্ঠু বিচারকার্য ব্যাহত হতে পারে, অপরাধের তদন্তপ্রক্রিয়া এবং অপরাধীর গ্রেপ্তার ও শাস্তিকে প্রভাবিত করতে পারে।
পরে হাম্মাদি ১০ আগস্ট তথ্য কমিশনে অভিযোগ করেন। কমিশন ৮ মার্চ পুলিশকে নির্দেশ দেয় আবেদনকারীকে ২০ দিনের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করতে। যেখানে আদালতের রায়ের বাস্তবায়নে গাফিলতির নজির রয়েছে, সেখানে তথ্য কমিশনের নির্দেশ পুলিশ আদৌ প্রতিপালন করবে কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এমন শঙ্কার কারণ, তথ্য চেয়ে আবেদনকারী হাম্মাদির এক বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন, তার তথ্য চাওয়া নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সন্দেহ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করেন। এতে হয়রানি বোধ করেছেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তথ্য চাওয়ার একটি আবেদন সুরাহা করতে ৯ মাস লেগেছে। আইনকে কিভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে এ ঘটনায় তা স্পষ্ট। বাংলাদেশের নাগরিক সাদ হাম্মাদি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক অফিস শ্রীলঙ্কায় কর্মরত। তার এ পরিচিতি তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসেনি। এ ধরনের তথ্য সবার আগে চাওয়ার কথা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের। সম্ভবত সরকারি দফতরের কাছে তথ্য চাওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা এরই মধ্যে হতাশ। তাই তারা আগ্রহ দেখান না। একটা তথ্য পুলিশের কাছ থেকে আদায় করতে ঘাটে ঘাটে ঘুরতে হয়েছে। সাধারণ নাগরিকের জন্য তথ্য পাওয়া কতটা দুরূহ ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। আসলে আইন করাই যথেষ্ট নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো আইনের বাস্তবায়ন। আমরা চাই তথ্য অধিকার আইন সত্যিকারার্থে বাস্তবায়ন হোক।
তারা বলেন, মনে প্রশ্ন জাগায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তারের সংখ্যার বিষয়ে এত সংবেদনশীল কী রয়েছে? এটা ইতোমধ্যেই সরকারি হিসাবের অংশ এবং যে কারো সেখান থেকে তথ্য পাওয়া অধিকার আছে।
এ সব তথ্য কোন পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে তাও স্পষ্ট নয়। এমনকি আমরা যদি দাবি করি, তথ্যগুলো ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল’ তাহলে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সেগুলো প্রকাশের সম্ভাব্য ফলাফল ব্যাখ্যা করা এবং একজন নাগরিকের উদ্দেশ্য ও পরিচয়ের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তাকে অপমানিত করা হয়েছে। এটি পুলিশের স্বচ্ছতার দাবির সঙ্গেও মেলে না।
তথ্য অধিকার আইনের ধারা ৭-এর অধীনে সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য সরবরাহের অনুরোধ উপেক্ষা করার সুযোগ থাকায় সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কমিশনের জানা উচিত, নাগরিকদের তথ্য জানার অধিকার ও জনস্বার্থ রক্ষায় সরকারের অধিকারের সমন্বয় করা তার কাজের মূল অংশ। কাজটি এমনভাবে করতে হবে যাতে নাগরিকরা তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত না হন।
তারা আরও বলেন, এখন পর্যন্ত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব ও ভিন্নমত দমনে কীভাবে তা প্রায়শই অপব্যবহার করা হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আইনটির আরও বেশি অপব্যবহারের সুযোগ না দিয়ে প্রকৃত পরিস্থিতি চিত্রিত করে তথ্য প্রকাশের যেকোনো প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানানো উচিত।
তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে সবার যাতে সুরক্ষা ও অধিকারপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয় যে জন্য আমরা কমিশনকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১২
আপনার মতামত জানানঃ