ঋণের চাপে ও আর্থিক সংকটে খুব দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। রিজার্ভ না থাকায় জ্বালানি, জরুরি ওষুধ ও খাদ্য আমদানি করতে পারছে না দেশটির সরকার। কাগজ কিনতে না পারায় বাতিল করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে আরও ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এবং অন্যান্য ঋণদাতাদের কাছে ধর্না দিচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
খাদ্য ঘাটতি, অর্থনৈতিক দুর্দশার জেরে তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নিচ্ছেন শ্রীলঙ্কার উদ্বাস্তুরা । গত মঙ্গলবার(২২ মার্চ), ১৬ জন শ্রীলঙ্কার নাগরিক দুটি ধাপে তামিলনাড়ুতে এসে পৌঁছেছেন। এরা প্রতেক্যেই শ্রীলঙ্কার উত্তরে জাফনা এবং মান্নার অঞ্চলের তামিল সম্প্রদায়ের মানুষ।
তিন শিশুসহ ছয় শরণার্থী রামেশ্বরমের উপকূলে একটি দ্বীপের কাছে আটকা পড়েছিল, ভারতীয় কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে। দশজনের দ্বিতীয় দলটি গভীর রাতে তামিলনাড়ু পৌঁছায়।
তামিলনাড়ু পুলিশের সূত্র দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছে যে, শ্রীলঙ্কায় বেকারত্ব এবং খাদ্যের অভাব থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়েছেন শরণার্থীরা। আগামীদিনে লঙ্কার উত্তর তামিল-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি থেকে আরো মানুষ ভারতে চলে আসবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
তামিলনাড়ুর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তথ্য পেয়েছেন যে, আগামী সপ্তাহে প্রায় ২০০০ উদ্বাস্তু আসার সম্ভাবনা রয়েছে৷ শ্রীলঙ্কার প্রথম গ্রুপের ছয় শরণার্থীর মধ্যে একজন তরুণ দম্পতি এবং তাদের চার মাস বয়সী ছেলে এবং অন্য একজন মহিলা ও তার দুই সন্তান রয়েছে।
দ্বিতীয় গ্রুপের পরিচয় যাচাই করা হচ্ছে, যার মধ্যে তিনজন নারী ও পাঁচ শিশু রয়েছে। প্রথম দলের ছয় শরণার্থী পুলিশকে বলেছে যে, কয়েক সপ্তাহ ধরে খাবারের জন্য লড়াই করার পর তারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতের জলসীমায় প্রবেশের জন্য জেলেদের তারা ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন বলেও দাবি করেছেন।
শরণার্থীরা বলছেন, খাদ্য ও জ্বালানির তীব্র ঘাটতি এবং আয়ের অভাবের কারণে আরও অনেক পরিবার ভারতে পালানোর সুযোগ খুঁজছে।
শরণার্থীদের প্রথম দলটিকে উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার আগে কোস্টগার্ড ক্যাম্পে তাদের খাবার দেওয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের সবাইকে রামেশ্বরমের কাছে মণ্ডপম শরণার্থী শিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
শরণার্থীদের দ্বিতীয় দলটি একটি ফাইবার বোটে ভারতীয় উপকূলে পৌঁছায়। তারা শ্রীলঙ্কার মান্নার উপকূল ছাড়ার পর ভারতে প্রবেশের জন্য ৩ লক্ষ টাকা খরচ করেছে বলে দাবি করেছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাথে কথা বলার সময়, মান্নারের এক মানবাধিকার কর্মী ভি এস শিবকরণ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘এটি দেশত্যাগের সূচনা মাত্র। আমার পরিচিত অনেক লোক শ্রীলঙ্কা ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে, কারো কারো আত্মীয় ভারতীয় ক্যাম্পে আছে, কারো কারো যোগাযোগ আছে তামিলনাড়ুতে। এরা প্রত্যেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। কারণ এই সপ্তাহে শ্রীলঙ্কায় চালের দাম কেজি প্রতি ৫০০ টাকা ছুঁয়েছে। চিনি ২৯০ টাকা কেজি এবং ৪০০ গ্রাম দুধের গুঁড়ার জন্য মানুষকে দিতে হচ্ছে ৭৯০ টাকা। দুধের গুঁড়ার দাম গত তিন দিনে ২৫০ টাকা বেড়েছে’।’
শ্রীলঙ্কায় বেকারত্ব এবং খাদ্যের অভাব থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়েছেন শরণার্থীরা। আগামীদিনে লঙ্কার উত্তর তামিল-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি থেকে আরো মানুষ ভারতে চলে আসবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সুরেশ প্রেমচন্দ্রন, যিনি রাজনৈতিক সংগঠন ইলম পিপলস রেভোলিউশনারি লিবারেশন ফ্রন্ট (ইপিআরএলএফ) এর প্রধান, তিনি বলেছেন ”শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ক্রমে ক্ষোভ বাড়ছে। সারা দেশে মূল্যস্ফীতির কারণে নির্মাণ শ্রমিক ও দিনমজুররা হিমশিম খাচ্ছেন। মান্নার এবং জাফনার লোকেরা ভারতে পৌঁছানোর উপায় খুঁজতে শুরু করেছেন। দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল না হলে আরও বেশি লোকের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে’।
শ্রীলঙ্কায় হু হু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। চাল ও দুধের মতো খাদ্যপণ্যের দামও আকাশচুম্বী। পেট্রোল ও ডিজেল না থাকায় জ্বালানি পাম্প স্টেশনগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ছাপা ও পরীক্ষা নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত কাগজ আমদানি সম্ভব না হওয়ায় স্কুল পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিন শিশুসহ উদ্ধার হওয়া দলটি জানায়, শ্রীলঙ্কায় তাদের কোনো চাকরি নেই। নিত্যপণ্যও মিলছে না। কালোবাজারে চড়াদামে বিক্রি হচ্ছে পণ্য। ফিলিং স্টেশনগুলোতেও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মানুষ।
তারা জানায়, ৫০ হাজার রুপির বিনিময়ে এক মাঝি মঙ্গলবার সকালে তাদের রামেশ্বরমের কাছে নামিয়ে দিয়ে যায়। পরবর্তীতে ভারতীয় উপকূল রক্ষাকারী বাহিনী দলটিকে উদ্ধার করে। সেদিন বিকেলে আরও ১০ জনের একটি দল এলেও তাদের বিবরণ পাওয়া যায়নি।
বুধবার রামানাথপুরমের একটি আদালতে তাদের হাজির করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভয়ংকর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে শ্রীলঙ্কা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতেও চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগে ৮০-র দশকের শুরুতে গৃহযুদ্ধের কারণে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয় তামিল নাড়ু। বর্তমানে রাজ্যের ১০৭টি শিবিরে প্রায় ৬০ হাজার শরণার্থী বসবাস করছে। এর বাইরে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা আরও ৩০ হাজার মানুষ সেখানে বসবাস করছেন।
শ্রীলঙ্কার মূল সমস্যা হলো তার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। কথিত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গত কয়েক বছরে চীনসহ বিভিন্ন দেশের কাছে বাছবিচারহীনভাবে ঋণ নিয়েছে দেশটির সরকার।
এতে দেশটির বন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও ঋণের ফাঁদে পড়ে যায় কলম্বো। বছর বছর ঋণের সুদ দিতে দিতে তলানিতে ঠেকেছে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
শ্রীলঙ্কার সরকারের ভরসা ছিল পর্যটন শিল্পের ওপর। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উল্লেখযোগ্য অংশের যোগান দেয় পর্যটন খাত। তবে করোনা মহামারির কারণে সেখানেও মন্দা দেখা দেয়। ফলে পর্যটন খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার যোগান পায়নি দেশটি। তার ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত কয়েক মাস ধরে বেড়ে যাওয়া তেলের দামের কারণে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বেশিরভাগ চলে যাচ্ছে তেল আমদানি করতেই।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলারও আর অবশিষ্ট নেই তাদের হাতে। জ্বালানির অভাবে পাওয়ার স্টেশন বন্ধ থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা হচ্ছে লোডশেডিং।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে সাধারণ মানুষ এখন যারা এ দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছেন, তাদেরই দায়ী করছে। জ্ঞান প্রসাদ নামের একজন গাড়িচালক বলেন, ‘আমি সরকারকে এ জন্য দায়ী করছি না। যারা এই সরকারকে ভোট দিয়েছেন, দোষটা আসলে তাদের।’
ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও জ্বালানি তেল না পেয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ও জ্বালানি তেল বিতরণ পর্যবেক্ষণে গত মঙ্গলবার সেনা মোতায়েন করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, রাজাপক্ষে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে, সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে।
শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু সিংহলিরা গৃহযুদ্ধের কারণে ভারতের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল, যার সুযোগ নেওয়ার জন্য তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে গণচীনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে পড়েছিলেন।
চীনও শ্রীলঙ্কার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশটিকে নিজেদের প্রভাববলয়ে টেনে নেওয়ার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় হামবানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চায়নিজ সিটি নির্মাণসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পে সহজ শর্তে প্রকল্প ঋণ প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে যখন হামবানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হয়, তখন দেখা গেল যে বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
বন্দরের আয় বাড়াতে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটিকে চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়। একই রকম বিপদে পড়তে হচ্ছে কলম্বোর চায়নিজ সিটি ও কয়েকটি বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়ে। যথাযথ ‘প্রকল্প মূল্যায়ন’ পদ্ধতি অবলম্বনে এসব প্রকল্প গৃহীত না হওয়ায় এগুলোর কোনোটাই যথেষ্ট আয়বর্ধনকারী প্রকল্প হয়ে উঠবে না।
এ জন্যই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মহলে বলা হচ্ছে, লোভে পড়ে শ্রীলঙ্কা ‘চীনা ঋণের ফাঁদে’ আটকে গেছে। আরও মারাত্মক হলো, ‘সভরেন বন্ড’ ছেড়ে শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক অর্থবাজার থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার পুঁজি সংগ্রহ করেছিল ওই সময়ে, যেগুলোর ম্যাচিউরিটি ২০২২ সাল থেকেই শুরু হতে চলেছে। কিন্তু এখন তো সুদাসলে ওই বন্ডের অর্থ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য শ্রীলঙ্কার নেই।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, রাজাপক্ষে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে, সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৬
আপনার মতামত জানানঃ