ভুট্টার ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে এশিয়ায় অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে চালের বাজার। সম্প্রতি পশুখাদ্যের জন্য ব্যবহূত নিম্নমানের চালের চাহিদাও বেড়েছে লক্ষণীয় মাত্রায়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি অবস্থান করছে। ঠিক এমন সময়ই বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য হিসেবে বিবেচিত চালের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এতে করে অঞ্চলটিতে খাদ্যপণ্য সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার উদ্বেগ তীব্র হচ্ছে।
ভুট্টার দুই রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানোর কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে পণ্যটির দাম। বাড়ছে সংকটও। একদিকে বাড়তি দাম, অন্যদিকে সরবরাহ কম থাকায় বিপাকে পড়ছে আমদানিকারক দেশগুলো।
ভুট্টার সরবরাহের সংকট এবং ক্রমবর্ধমান দামের কারণে স্থানীয় গবাদি পশু এবং হাঁস-মুরগির খাদ্য উৎপাদনকারীরা উৎপাদন লাইনে শস্যের জায়গায় চাল ব্যবহার শুরু করেছেন। এটি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে স্থানীয় বাজারে। বিশ্বব্যাপী প্রাণীখাদ্য তৈরির জন্য ভুট্টা ব্যবহারকারী অনেক দেশই এখন বিকল্প হিসেবে ব্রোকেন রাইস বা রাইস পলিশ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে।
যুদ্ধের কারণে ভুট্টার সংকট
ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে ২৫ কেজি ভুট্টার দাম ছিল ৬.৬ ইউএস ডলার। যা এখন ৭.৬ ডলারে উঠেছে।
ইউএসডিএ এর তথ্য বলছে, ভুট্টার বৈশ্বিক রপ্তানির প্রায় ১৫ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এর মধ্যে ইউক্রেন সরবরাহ করে ১৩ শতাংশ, দুই শতাংশ রাশিয়া। যুদ্ধের কারণে এই দুই দেশের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ভুট্টার দাম করোনার আঘাতের পর থেকেই বাড়তে শরু করেছে। এখন আবার তা যুদ্ধের কারণে বাড়ছে। ২০২০ সালে প্রতি কেজি ভুট্টার দাম ছিল ২৮.১৭ টাকা, যা ২০২২ সালে ২৮ টাকা এবং বর্তমানে প্রায় ৩৩ টাকায় উঠেছে।
অর্থাৎ এই দুই বছরে ভুট্টার দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। একই সঙ্গে পলিশ রাইসের দাম বেড়েছে ৭১ শতাংশ। সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৮৮ শতাংশ।
ভুট্টার সংকটে বাড়ছে চালের ঘাটতি
বাংলাদেশের ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ফিড তৈরিতে ভুট্টার বিকল্প হিসেবে পলিশ রাইস বা ব্রোকেন রাইসের ব্যবহার কিছুটা বাড়ানো যাবে। তবে সম্পূর্ণরূপে ভুট্টার ব্যবহার বন্ধের উপায় নেই।
আবার পলিস রাইস বেশি ব্যবহার করতে গেলে সেক্ষেত্রে স্থানীয় চালের সরবরাহে ঘাটতির সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বাংলাদেশের ফিড উৎপাদনকারীরা বলছেন, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম উৎপাদনের জন্য যে খাদ্য তৈরি করা হয় তার মধ্যে প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ ভুট্টার ব্যবহার করা হয়। আর ১০ শতাংশের মত ব্যবহার হয় পলিশ রাইস। ভুট্টার ব্যবহার যদি কমে তবে বাংলাদেশেও পলিশ রাইসের ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বাড়তে পারে।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিয়াব) এর প্রেসিডেন্ট ইহতেশাম বি শাহজাহান বলেন, ভুট্টার বিকল্প হিসেবে পলিশ রাইসের ব্যবহার কিছুটা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে দুটি পণ্যে একই ধরনের পুষ্টিগুণ না থাকায় পুরোপুরি ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া সম্ভব না।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬০-৬৫ লাখ টন প্রাণীখাদ্য তৈরি হয়। এই প্রাণীখাদ্য তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ৫৫-৬০ শতাংশ ব্যবহার হয় ভুট্টা, ১০ শতাংশ পলিশ রাইস, ২৫-৩০ শতাংশ ব্যবহার হয় সয়াবিন মিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন মিল ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে থাকে। নিজেদের স্টক বাড়াতে সয়াবিনের বড় রপ্তানিকারক দেশ আর্জেন্টিনা সয়াবিনের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এর প্রভাবও পড়ছে প্রাণীখাদ্য তৈরিতে।
ইহতেশাম বি শাহজাহান জানান, ভুট্টার দাম বৃদ্ধি ফিড উৎপাদনকারীদের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ফিডের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকেই ফিডের উপাদানগুলোর দাম বেড়েছে গড়ে ৮০ শতাংশ।
সেসময় ফিডের দাম বাড়ানো হয়েছে ২০-২৫ শতাংশ। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্রয়লার মুরগি, ডিম, দুধের দাম বাড়েনি। এখন নতুন করে ফিডের দাম আরও বাড়লে চাপে থাকা খামারিরা ব্যবসা ছেড়ে দেবে।
চাল আমদানি বাড়াচ্ছে চীন
রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাণীখাদ্য তৈরির জন্য ভুট্টার বিকল্প হিসেবে এশিয়া অঞ্চল থেকে ব্রোকেন রাইস বা পলিশ রাইস কিনছে চীন। যার প্রভাবে ভারতে ব্রোকেন রাইসের দাম টনপ্রতি ২৯০ ডলার থেকে ৩২০ ডলারে উঠে গেছে।
এদিকে ইউএসডি এর তথ্য বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। দেশটি ২০২০-২১ বছরে ২৯.৫১ মিলিয়ন টন ভুট্টা আমদানি করেছে। যেখানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক রপ্তানির ১ শতাংশ আমদানি করে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছরের জন্য ইউক্রেনীয় ভুট্টার দুই মিলিয়ন টন পর্যন্ত বুক করেছিল চীন। কিন্তু ইউক্রেনের লজিস্টিক চেইনগুলোতে ব্যাঘাতের কারণে সেই চালানের বেশিরভাগই এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এই হারানো ভলিউম প্রতিস্থাপন করতে, চীন প্রায় তিন মিলিয়ন টন ভাঙ্গা চাল আমদানি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দাম বৃদ্ধির শঙ্কা
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) চালের বাজারবিষয়ক অর্থনীতিবিদ শার্লি মুস্তাফা বলেন, গম ও ভুট্টার বাজারে যে অস্থিরতা চলছে, তা অব্যাহত থাকলে পশুখাদ্য হিসেবে ভাঙা চালের চাহিদা অনন্য উচ্চতা পৌঁছবে।
শুধু পশুখাদ্যই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও শস্যটির ব্যবহার বাড়বে। বিশেষ করে চালকে নিত্যদিনের খাবারের তালিকায় রাখা মানুষের সংখ্যা অন্য যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বেইজিংভিত্তিক চাল ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছরের জন্য চীন ইউক্রেনের সঙ্গে ২০ লাখ টন ভুট্টা আমদানির চুক্তি করেছে। কিন্তু দেশটির লজিস্টিক চেইনে সংকটের কারণে শস্যগুলোর বেশির ভাগ চালানই আটকে আছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চীন ৩০ লাখ টন ভাঙা চাল আমদানির কথা ভাবছে। অথচ দুই বছর ধরে দেশটি বছরে ২০ লাখ টনের বেশি ভাঙা চাল আমদানি করেনি।
অন্য একটি সূত্র জানায়, চীনের গোয়াংডং প্রদেশের এক আমদানিকারক থাইল্যান্ড থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে অন্য আমদানিকারকরা পশুখাদ্যে জোগান দিতে সম্প্রতি ভারত থেকে ভাঙা চাল কিনেছে।
ভারতের রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বি ভি কৃষ্ণ রাও বলেন, ভুট্টার ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ভারতীয় ভাঙা চালের চাহিদা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভুট্টার জায়গায় চালকে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করছেন।
তিনি জানান, চলতি মাসে শতভাগ ভারতীয় ভাঙা চালের দাম বেড়ে টনপ্রতি ৩২০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। অথচ গত মাসে এ চালের দাম ছিল টনপ্রতি ২৯০ ডলার।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৮
আপনার মতামত জানানঃ