ফেসবুকের সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির গোপন আঁতাতের অভিযোগ আনলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। গতকাল বুধবার লোকসভায় ‘জিরো আওয়ারে’ এই অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভারতীয় রাজনীতিতে যেভাবে হস্তক্ষেপ করছে, সরকারের উচিত তা বন্ধ করা।
অভিযোগের পক্ষে সোনিয়া উল্লেখ করেন কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘আল-জাজিরা’ ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য রিপোর্টার্স কালেকটিভ’ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের কথা। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যম ভারতের নির্বাচনের সময় বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাত করেছিল। ভোট প্রচারে দলীয় বিজ্ঞাপনে তাদের অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছিল। বিজেপির তুলনায় অন্য দলের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল বেশি অর্থ।
প্রসঙ্গত, ভারতের পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন শেষ। এর চারটিতে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জয় এসেছে। তবে বিজেপির এই জয়ে হাত আছে ফেসবুকের। ভোটের পর এমন তথ্য সামনে এসেছে। এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ফেসবুকে নির্বাচনী প্রচারে বিজ্ঞাপনে সুবিধা দেওয়া হয়েছে বিজেপিকে। অন্য দলগুলোর চেয়ে তাদের কম মূল্যে বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিজেপির জয়ে ফেসবুকের ভূমিকা
ফেসবুকের সঙ্গে বিজেপির আঁতাতের অভিযোগ এই প্রথম নয়। লোকসভার গত নির্বাচনের সময়েও নানা বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের প্রভাব খাটানোর অভিযোগে বিরোধীরা সরব হয়েছিল। বিরোধী নেতাদের টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া বা নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করার অভিযোগও উঠেছিল।
অভিযোগ উঠেছিল ‘বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য’ বন্ধে শাসক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের। বাণিজ্যিক স্বার্থে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসক দলকে খুশি রাখতে এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখনো সক্রিয়, এটাই সোনিয়া গতকাল নতুন করে বললেন।
ভারতে গত ২২ মাসে একটি লোকসভা নির্বাচনসহ ১০টি নির্বাচনের বিজ্ঞাপন ব্যয় বিশ্লেষণ করে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯টি নির্বাচনেই জিতেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
ভারতে ফেসবুকের বড় রাজনৈতিক গ্রাহক বিজেপি। কম মূল্যে বিজ্ঞাপনের সুযোগ পেয়ে বিজেপি অনেক বেশি ভোটারের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে।
ভারতে অনলাইনে প্রচারিত রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে দেশটির অলাভজনক সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দ্য রিপোর্টার্স কালেক্টিভ (টিআরসি) ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান অ্যাড ওয়াচ।
তারা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ফেসবুকে ৫ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করেছে। তারা ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার ‘ট্রান্সপারেন্সি টুল’ অ্যাড লাইব্রেরি অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেসের (এপিআই) মাধ্যমে এসব বিজ্ঞাপন–সংশ্লিষ্ট তথ্য পেয়েছে।
বিভিন্ন দেশ থেকে ফেসবুকে যেসব রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, তার সব তথ্য এ টুলের মাধ্যমে পাওয়া যায়। টিআরসি বলছে, ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারিত বিজ্ঞাপন থেকে জানা যাচ্ছে, একটি বিজ্ঞাপন ১০ লাখ বার দেখানোর জন্য বিজেপি নেতা বা এর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৪১ হাজার রুপি।
আর দেশটির বিরোধী দল কংগ্রেসের একটি বিজ্ঞাপন ১০ লাখ বার দেখানোর জন্য নেওয়া হয়েছে ৫৩ হাজার রুপি। অর্থাৎ বিজেপির তুলনায় প্রায় ২৯ শতাংশ অর্থ বেশি নেওয়া হয়েছে কংগ্রেসের কাছ থেকে।
টিআরসি ও অ্যাড ওয়াচ প্রাথমিকভাবে ফেসবুকে বিজেপি ও কংগ্রেসের বিজ্ঞাপনী খরচ হিসাব করে এর একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২২ মাসের ব্যবধানে বিজেপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো ব্যয় করেছে ১০ কোটি ৪১ লাখ রুপি। আর কংগ্রেস ব্যয় করেছে ৬ কোটি ৪৪ লাখ রুপি।
কংগ্রেস কম খরচ করলেও তুলনাটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। কংগ্রেস যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে বিজ্ঞাপনটি যত ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছেছে, তার থেকে ১ কোটি ১৭ লাখ রুপি কম ব্যয় করে সেই পরিমাণ ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছেছে বিজেপি।
এর বাইরে বিজেপি ও কংগ্রেসের প্রচারের আরেকটি দিক তুলে ধরেছে টিআরসি ও অ্যাড ওয়াচ। এ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিজেপির হয়ে প্রচার চালিয়েছেন অনেকে। কিন্তু কংগ্রেসের হয়ে এ ধরনের প্রচার চালাতে গিয়ে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, কংগ্রসের হয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে গেলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
দলগুলোর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য পক্ষের বিজ্ঞাপনের মূল্যে পার্থক্য দেখা গেছে। কংগ্রেসের জন্য এ রকম বিজ্ঞাপন প্রচারে প্রতি ১০ লাখ ভিউয়ের জন্য খরচ হয়েছে ৫২ হাজার রুপি। বিপরীতে বিজেপির খরচ ৩৯ হাজার রুপি।
গণতন্ত্রের জন্য হুমকি
এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আদালত বলেছিলেন, ফেসবুকের যে নীতি ও অ্যালগরিদম, তা দেশটির গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থার জন্য হুমকির। আদালত আরও বলেছিলেন, নির্বাচন ও ভোট একটি গণতান্ত্রিক সরকারের ভিত্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হস্তক্ষেপের কারণে তা হুমকির মুখে।
এ নিয়ে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার কাছ থেকে বেশ কিছু বিষয় জানতে চেয়ে ই–মেইল করা হয়েছিল। তবে এসব প্রশ্নের বিস্তারিত কোনো উত্তর দেয়নি মেটা। এমনকি বিজ্ঞাপনের দামের পার্থক্যের বিষয়েও কিছু বলেনি প্রতিষ্ঠানটি।
মেটার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি পক্ষপাতের উর্ধ্বে গিয়ে আমরা সার্বিকভাবে একই নীতি গ্রহণ করি।’
কিন্তু মেটার এ বক্তব্যের সঙ্গে কাজের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন ২০১৯ সালে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ভারতের ওডিশা, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম ও অন্ধ্র প্রদেশে। এসব ভোটে ফেসবুকে প্রতি ১০ লাখ ভিউয়ের জন্য বিজেপির ব্যয় ৬১ হাজার রুপি। আর কংগ্রেসের ব্যয় ৬৬ হাজার রুপি। এ ছাড়া হরিয়ানা ও ঝাড়খন্ডেও একই ধরনের চিত্র লক্ষ করা গেছে।
২০২০ সালে ভোট হয় দিল্লি বিধানসভার। এ ভোটের বিজ্ঞাপনে ১০ লাখ ভিউয়ের বিপরীতে বিজেপির ব্যয় ৩৫ হাজার রুপি। আর কংগ্রেসের ব্যয় ৩৯ হাজার রুপি। এ নির্বাচনে জিতেছে আম আদমি পার্টি। তাদের ব্যয় হয়েছে ৬৪ হাজার রুপি। অর্থাৎ বিজেপির চেয়ে আম আদমি পার্টির ৮০ শতাংশ ব্যয় বেশি হয়েছে।
বিহার রাজ্যে আরও বেশি অর্থ গুনতে হয়েছে কংগ্রেসকে। এ বিধানসভা বিজ্ঞাপনে প্রতি ১০ লাখ ভিউয়ের বিপরীতে কংগ্রেসকে খরচ করতে হয়েছে ৪৫ হাজার রুপি। বিজেপিকে খরচ করতে হয়েছে ৩৭ হাজার রুপি। আর জনতা দল ইউনাইটেডকে এ ভোট ব্যয় করতে হয়েছে ৬৬ হাজার রুপি।
তবে মহারাষ্ট্রে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এ রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারের বিজ্ঞাপনে ১০ লাখ ভিয়ে বিজেপির ব্যয় ৪৩ হাজার রুপি। আর কংগ্রেসের ব্যয় ৩৮ হাজার রুপি।
ফেসবুকের এ পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছিল টিআরসি। কিন্তু তারা কোনো সাড়া দেয়নি। এছাড়া বিজেপিও কোনো মন্তব্য করেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ