হিটলার অনেক পূর্বেই সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন যাতে করে তিনি তার দেশের মানুষদের বসবাস করার জন্য বিস্তৃত একটি অঞ্চল দখল করে নিতে পারেন। ১৯৩৯ সালে রাশিয়া এবং জার্মানি একটি শান্তি চুক্তি করলেও তাদের মধ্যে অতিমাত্রায় পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস থাকার কারণে সেই চুক্তিটি কোন কাজে দেয়নি।
১৯৩৯ সালে অ্যাডলফ হিটলার তার সেনাবাহিনীকে জানান পরবর্তী যুদ্ধটি হবে একটি জাতিগত যুদ্ধ। ১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হিটলার ঘোষণা করেন, “জাতিগত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং এই যুদ্ধ নিশ্চিত করবে কোন দেশ ইউরোপ তথা সারা পৃথিবী শাসন করবে।”
হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান বাহিনী বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে ইউরোপ সহ সারা পৃথিবী শাসনের অভিপ্রায় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে জার্মানির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শুরু করে অপারেশন বারবারোসা।
অপারেশন বারবারোসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে জার্মান বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল তারা সোভিয়েত ভূখণ্ড দখল করার পর রাশিয়ান এবং স্লাভ জনগণকে হত্যা করে নয়ত বিতাড়িত করে অথবা তাদের দাসে পরিণত করে সোভিয়েত রাশিয়াতে জার্মানদের বসতি গড়বে এবং জার্মান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করবে।
২২ জুন ১৯৪১ সালে ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। অ্যাডলফ হিটলার তার নাৎসি বাহিনীকে বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে রাশিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন। হিটলারের নির্দেশের পর জার্মান প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক পদাতিক সৈন্য, ৬-৭ লাখ অশ্বারোহী, ২৫০০ বিমান, ৩০০০ ট্যাংক, ৭০০০ কামান এবং অন্যান্য অসংখ্য যুদ্ধাস্ত্র এবং কয়েক লক্ষাধিক মোটরযান নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।
সোভিয়েত রাশিয়ার ‘লাল ফৌজ’ যুদ্ধাস্ত্র, সৈন্য সংখ্যা এবং যুদ্ধকৌশলের দিক দিয়ে জার্মান বাহিনীর চেয়ে বহুগুণ পিছিয়ে ছিল। ফলে জার্মান বাহিনীর শুরুর আক্রমণ কাটিয়ে উঠতে না পেরে সোভিয়েত বাহিনী পিছু হটতে থাকে। ফলে যুদ্ধের কয়েক দিনের মধ্যে জার্মান বাহিনী ইউক্রেনসহ সোভিয়েত রাশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে প্রায় ৩০০ মাইল ঢুকে পরে। জার্মান বাহিনীর আক্রমণে প্রথম তিনদিনে রাশিয়ার প্রায় ৩৯২২টি বিমান ধ্বংস হয়ে যায়, অন্যদিকে রাশিয়া জার্মান বাহিনীর মাত্র ৭৮টি বিমান ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।
শুরুতে বড় সাফল্য পাওয়ার পর হিটলার চেয়েছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাল ফৌজকে পরাজিত করে সোভিয়েত রাশিয়া দখল করে নিতে। জার্মান বাহিনী তাদের সাফল্য বজায় রাখতে রাখতে মস্কোর কাছাকাছি যখন চলে আসে তখন রাশিয়ায় নেমে আসে ডিসেম্বরের তীব্র শীত। যে শীতের সাথে জার্মান বাহিনী অভ্যস্ত ছিল না। ফলে তারা এক প্রকার জমতে শুরু করে। এবং তখনই সোভিয়েত বাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ফলে জার্মান বাহিনীর মস্কো দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু জার্মান বাহিনীর তখনও বিপুল সংখ্যক সৈন্য এবং যুদ্ধাস্ত্র ছিল। ফলে হিটলার দমে না গিয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হোন এবং পূর্ব ফ্রন্টের দায়িত্ব নেন।
এদিকে রাশিয়াতে জার্মান বাহিনীর যত দিন যাচ্ছিল জ্বালানি তত বেশি কমে আসছিল। ফলে হিটলার জ্বালানির নিশ্চয়তা পেতে চাইলেন। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রাশিয়ার চেচনিয়ার তেলের খনিগুলো দখল নেওয়ার। তেলের খনির দখল নেওয়ার জন্য তিনি তার ফ্রন্টের সেনাবাহিনীর একটি অংশকে দুই ভাগে ভাগ করে চেচনিয়া এবং স্ট্যালিনগ্রাদের দিকে পাঠান। কিন্তু জার্মান বাহিনী অনেক দেরি করে ফেলেছিল। চেচনিয়ার তেলের খনি জার্মানদের হাতে পড়ার আগেই সোভিয়েতরা খনিতে আগুন ধরিয়ে দেন। ফলে জার্মান বাহিনী তেলের খনি দখল করতে ব্যর্থ হয়।
হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের মূল যুদ্ধ সংগঠিত হয় জোসেফ স্ট্যালিনের নিজ নামে গড়া শহর স্ট্যালিনগ্রাডে। সোভিয়েত রাশিয়ার স্ট্যালিনগ্রাড শহরটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হিটলার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি দখল করে নেওয়ার। রাশিয়ার শিল্পোন্নত সাজানো-গোছানো এই শহরটি দখল করার জন্য হিটলার তার অত্যন্ত দক্ষ ষষ্ঠ পদাতিক বাহিনীকে পাঠান। ষষ্ঠ পদাতিক বাহিনী বেশ কয়েকটি যুদ্ধে সাফল্য দেখিয়েছে ফলে হিটলার এদের উপরই আস্থা রেখেছিলেন।
হিটলারের ষষ্ঠ পদাতিক বাহিনী ধীরে ধীরে স্ট্যালিনগ্রাডে ভলগা নদীর তীরে পৌঁছায়। সেখানে জার্মান বাহিনী অবরোধের মুখে পড়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ষষ্ঠ পদাতিক বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য সাঁজোয়া বাহিনী চতুর্থ প্যাঞ্জারের যোগ দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু জ্বালানি সঙ্কটের কারণে সাঁজোয়া বাহিনীটি ঠিক সময়ে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
স্ট্যালিনগ্রাডে শহরের বাইরে থাকা পদাতিক সৈন্যরা প্রথমে আক্রমণ করেনি। প্রথমে জার্মানির দুর্ধর্ষ বিমান বাহিনী টানা সাতদিন স্ট্যালিনগ্রাড শহর বিমান হামলা চালিয়ে শহরটি একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। এরপর শুরু হয় পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ। তারা শহরের ভিতরে প্রবেশ করতে থাকে। প্রচণ্ড বিমান হামলার পর জার্মান বাহিনী ভেবেছিল খুব সহজেই স্ট্যালিনগ্রাডকে দখল করতে পারবে। কিন্তু মূল যুদ্ধ তখনও বাকি ছিল। জার্মান পদাতিক বাহিনী প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে, ফলে তারা খুব বেশি এগোতে পারছিল না। জার্মান বিমান বাহিনী নারকীয় হামলা চালিয়ে যে দালানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, সোভিয়েত বাহিনী সেগুলোকে প্রতিরক্ষা দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করছিল।
সোভিয়েত বাহিনী তখন গেরিলা আক্রমণকে বেছে নেয়। তারা রাতের অন্ধকারে গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে জার্মান বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে দিতে থাকে। স্ট্যালিনগ্রাডে জার্মান বাহিনীকে একই স্থান বার বার দখল করতে হয়েছে। দিনের বেলা জার্মান বাহিনী যে এলাকা দখল করতো, রাতের অন্ধকারে সোভিয়েত বাহিনী গেরিলা বাহিনী সেটি দখল করে নিতো। তবে জার্মান এবং সোভিয়েত বাহিনীর ইঁদুর-বিড়াল যুদ্ধের পরও জার্মানরা শহরটির প্রায় ৮০ ভাগ দখল করে নিয়েছিল।
জার্মানরা শহরের অধিকাংশ দখল করে নেওয়ার পর সোভিয়েত বাহিনী নিজেদের সংগঠিত করে ১৯ নভেম্বর জার্মান বাহিনীকে ফিরে ফেলে। তখনও জার্মানির সাঁজোয়া বাহিনী এসে পৌঁছাতে পারেনি ফলে জার্মান বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করতে পারেনি।
জার্মান প্যাঞ্জার বাহিনীর কোন সাহায্য না পাওয়ার কারণে এবং শহরের বাইরে লাল ফৌজের সৈন্য বৃদ্ধির কারণে জার্মানরা তাদের অন্য মিত্রদের সাহায্য থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে জার্মান বাহিনী স্ট্যালিনগ্রাডকে অবরোধ করতে এসে তারা নিজেরা লাল ফৌজের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে জার্মানরা চাইলে শুরুর দিকে অবরোধ ভেঙে পিছু হটে আসতে পারতো কিন্তু একগুঁয়ে হিটলার তার বাহিনীকে একচুলও পিছু না হটার নির্দেশ দেন। তিনি তার সৈন্যদের নির্দেশ দেন স্ট্যালিনগ্রাডের ভিতরে থেকে শহরটি দখল করে নেওয়ার এবং তাদের প্রয়োজনীয় রশদ বিমানে করে পাঠানো হবে।
কিন্তু দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ হয়ে থাকার কারণে জার্মান বাহিনী অস্ত্র এবং রসদ ফুরিয়ে আসে। হিটলার বিমানযোগে ষষ্ঠ পদাতিক বাহিনীর কাছে প্রতিদিন ১৪০টন রসদ পৌঁছে দিতো কিন্তু সেই রসদ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। ফলে দিন দিন রসদ এবং অস্ত্রের অভাবে জার্মান বাহিনী দুর্বল হতে থাকে। সেই সাথে খাবারের অভাবে জার্মান সেনারা মারা যেতে থাকে। শুধুমাত্র স্ট্যালিনগ্রাডে জার্মান বাহিনীর দেড় লক্ষাধিক সৈন্য মারা যায় এবং আরো প্রায় এক লক্ষাধিক সৈন্যকে বন্ধী করে সোভিয়েত বাহিনী, যার মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার জীবিত ফিরতে পেরেছিল। তবে জার্মান বাহিনীর চেয়ে সোভিয়েত বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল আরো অনেক বেশি।
হিটলারের স্বপ্ন ছিল রাশিয়া দখল করে তার সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করে সারাবিশ্বকে তার কাছে মাথানত করাবেন। সেই স্বপ্ন থেকে তিনি তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন। রাশিয়া আক্রমণের শুরুতে অভাবনীয় সাফল্য পেলেও জার্মান বাহিনী স্ট্যানিলগ্রাডে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। প্রচণ্ড শীত, জ্বালানী সঙ্কটের কারণে সাঁজোয়া বাহিনীর স্ট্যালিনগ্রাডে পৌঁছাতে বিলম্ব এবং সবশেষে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে অবরুদ্ধ হয়ে অনাহারে এবং যুদ্ধের রসদের অভাবে জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়।
স্ট্যালিনগ্রাদে ৫ মাসের যুদ্ধের পর ১৯৪৩ সালে ২ ফেব্রুয়ারি জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের খবর শুরুতে জার্মানিতে প্রচার করা হয়নি, তারা জানতেন তাদের সেনাবাহিনী রাশিয়াতে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। জার্মানরা যখন সুসংবাদের অপেক্ষা করছিল, ততদিনে স্ট্যালিনগ্রাডে নাৎসি বাহিনীর ২ লক্ষাধিক সৈন্যের কবর রচিত হয়ে গেছে।
১৩০ বছর পূর্বে ফরাসি অধিপতি নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন, নেপোলিয়নও ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং তার রাজত্বকাল শেষ হয়ে যায়। নেপোলিয়নের মতো হিটলারের রাশিয়া আক্রমণও ব্যর্থ হয় এবং তারও কবর রচিত হয় এখান থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর জয়রথ যখন লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটছিল তখন রাশিয়ার কাছে হিটলারের পরাজয় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই যুদ্ধের পর রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র সম্মিলিত ভাবে জার্মানির উপর আক্রমণ শুরু করে। রাশিয়ার কাছে হেরে জার্মানির শক্তি কমে যায়, ফলে জার্মানি মিত্র শক্তির কাছে একের পর এক হারতে থাকে। পরবর্তীতে জার্মান বাহিনী ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং হিটলার আত্মহত্যা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে একই সাথে জার্মানি এবং তার পরাজয় ডেকে আনেন। এই যুদ্ধে জার্মানির মোট ১০ লাখ সেনা হতাহত হয়েছিল, অন্যদিকে রাশিয়ার সৈন্য এবং সাধারণ মানুষ সহ মোট ৪৯ লাখ লোক হতাহত হয়েছিল। রাশিয়ায় যদি হিটলার জিততে পারতো তাহলে হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতো।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ