ইউক্রেনসহ তাদের প্রভাবশালী ইউরোপীয় মিত্র—মস্কো, কিয়েভ, প্যারিস ও বার্লিনকে ঘন ঘন শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি তাদের জাতীয় নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আলোচনা করছেন। চাইছেন এ সংকটের মেঘমুক্ত হোক ইউরোপ।
কিন্তু, আটলান্টিকের অপর পাড়ের আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অস্ত্র সরবরাহ করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উন্মাদনায় ইন্ধন যুগিয়েই চলছে—এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সামান্য একটি ভুল সিদ্ধান্তেই ইউক্রেন যুদ্ধ রূপ নিতে পারে আরও রক্তক্ষয়ী, সর্বনাশা মহারণে।
কী চাইছে আমেরিকা?
সরলদৃষ্টে মনে হয় আমেরিকা ইউক্রেনের পরম মিত্র। এই বিপদে তার সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধু। কিন্তু, আরেকটু গভীরভাবে দেখলে বুঝবেন, ইউক্রেন পুড়ে ছাই হোক- সেটাই চায় ওয়াশিংটন।
মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা সেখানে শান্তি চান না। চান প্রলম্বিত যুদ্ধ। যাতে রাশিয়ার স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায়। এর মাধ্যমে ইউরোপের অর্থনীতিতে নিজের প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ, প্রভুত্ব আরও শক্তিশালী করতে চাইছে। যুদ্ধের সুবাদে শক্তিশালী করতে চায়, ইউরোপের মাটিতে মার্কিন সেনা ও সরঞ্জামের উপস্থিতি।
এভাবে পুরো মহাদেশের নিয়ন্ত্রণও কার্যত রাখতে চায় হাতের মুঠোয়। কারণ, আমেরিকা জানে, ইউরোপের বাজার নিয়ন্ত্রণ করাসহ ইইউ অর্থনীতির প্রতিযোগিতা মোকাবিলাও তাতে সহজ হবে—ওয়াশিংটনের ভাবগতিকের তেমন উপসংহার টানছেন বিশেষজ্ঞরা।
কূটনৈতিক সমাধান খুঁজছে বিভিন্ন পক্ষ
বার্তাসংস্থা রয়টার্স গত রোববার ইউক্রেন-রাশিয়া আলোচনায় রুশ প্রতিনিধিদলের এক সদস্য লিওনিদ স্লুটস্কির বরাতে জানায়, উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠকে অনেকদূর অগ্রগতি হয়েছে, খুব শিগগির তারা একটি যৌথ অবস্থানে (ঐক্যমত্যে) পৌঁছানোর আশা করছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে আরও জানা যায়, ইউক্রেনীয় আলোচক ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াকও বলেছেন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এখন বেশ গঠনমূলক রূপ নিচ্ছে।
গত শনিবার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সাথে ফোনালাপ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী সেনা ব্যাটালিয়নগুলো যেন অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ করে সেজন্য কিয়েভের ওপর নিজেদের প্রভাব খাঁটাতে মাখোঁ ও শলৎজের প্রতি আহ্বান জানান পুতিন।
জার্মান সরকারের এক বিবৃতি অনুসারে, ফোনালাপে যত শিগগির সম্ভব যুদ্ধবিরতি ও কূটনীতিক সমাধানের তাগিদ দেন মাখোঁ ও শলৎজ। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ৭৫ মিনিটব্যাপী এই সংলাপ ছিল যুদ্ধ-নিরসনের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টারই অংশ।
যুদ্ধলিপ্ত দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে সংলাপের জন্য একটি সরাসরি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তুরস্কে যুদ্ধবিরতির আলোচনা করতে দ্বিপাক্ষিক এক বৈঠকে অংশ নেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও তার ইউক্রেনীয় প্রতিপক্ষ দিমিত্রো কুলেবা। যুদ্ধবিরতির চেষ্টা ব্যর্থ হলেও—তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাত নিরসনের আলোচনা চালিয়ে যেতে একমত হন।
এবিষয়ে ইস্ট চায়না নর্মাল ইউনিভার্সিটির রাশিয়া অধ্যয়ন কেন্দ্রের সহযোগী গবেষণা ফেলো চুই হেং গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, উভয়পক্ষের সদিচ্ছার প্রকাশ এই আলোচনা। তারা নিজেদের মধ্যে একটি ঐক্যমত্যের জায়গা সন্ধানের চেষ্টা করছে।
এদিকে, রাশিয়ার সঙ্গে সোমবারের ভিডিও কনফারেন্স বৈঠকের রূপরেখা দিয়েছেন ইউক্রেনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। মস্কোর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় বেশ অগ্রগতির তথ্য দিয়েছেন তারা।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির কার্যালয়ের সিনিয়র একজন কর্মকর্তা মনে করেন, মস্কোর অবস্থান আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি গঠনমূলক।
যুদ্ধ উস্কে দিচ্ছে আমেরিকা
তবে রুশ সেনাবাহিনী এখন পশ্চিম ইউক্রেন লক্ষ্য করে হামলা শুরু করেছে, যুদ্ধের তীব্রতা তাতে আরও বেড়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে নিকট ভবিষ্যতে আলোচনার মাধ্যমে বড় ধরনের সমঝোতায় পৌঁছানোর সুযোগ খুব কমই দেখা যাচ্ছে- বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে চুই হেং মনে করেন, যুদ্ধে যখন উভয়পক্ষের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হবে, যখন সংঘাত থেকে তাদের প্রাপ্তি শূন্যের কোঠায় নামবে—তখনই তারা চূড়ান্ত সমঝোতায় উপনীত হবে।
তবে ন্যাটোকে নেতৃত্বদানকারী আমেরিকা যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ উস্কে দিচ্ছে। বাহবা দিচ্ছে ইউক্রেনের প্রতিরোধ চেষ্টাকে। দিচ্ছে আরও অস্ত্র সহযোগিতা।
বার্তাসংস্থা রয়টার্স গত শনিবার জানায়, আমেরিকা ইউক্রেনে আরও ২০ কোটি ডলারের আগ্নেয়াস্ত্র, ট্যাংক-বিধ্বংসী মিসাইল, বিমান- বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাবে।
শনিবার অতিরিক্ত এ সহায়তার অনুমোদন দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফলে অতি দ্রুত এসব চালান সংঘাত অঞ্চলে পৌঁছানোর পথ বাধামুক্ত হয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন বাইডেন প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
বাইডেনের সবশেষ অনুমোদনের পর ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত ইউক্রেনকে ১২০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিল যুক্তরাষ্ট্র। আর ২০১৪ সালের পর থেকে তা দাঁড়িয়েছে ৩৪০ কোটি ডলারে।
যা বলছেন বিশ্লেষকরা
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ-রক্তপাত বন্ধ হোক—রাশিয়া, ইউক্রেন আর ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ)- এর সদস্য প্রভাবশালী রাষ্ট্র—সকলেই তা চায়। কারণ, যুদ্ধে তারা হয় সরাসরি ক্ষতির শিকার, নাহয় প্রভাবিত। নিজেদের মধ্যে বহু বিষয়ে মতভেদ থাকলেও যুদ্ধের প্রলয়কাণ্ড থামুক, সেটাই তারা একান্তভাবে চায়।
ইউক্রেনের প্রতিবেশী ইউরোপের দেশগুলো সংঘাত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আসা লাখো শরণার্থীকে উদারচিত্তে আশ্রয় দিচ্ছে। তাদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে। কিন্তু, ইউরোপ জানে উদারতারও সীমা আছে। সেজন্যই দ্রুত কূটনৈতিক সমাধানেই পৌঁছাতে হবে। কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যেই সে উপলদ্ধির কিছুটা আভাস মেলে।
চীনা বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনাপ্রবাহ ইইউ এবং আমেরিকার স্বার্থ ও অবস্থানের মৌলিক পার্থক্যগুলি তুলে ধরছে। ইউরোপের দুয়ারে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি নিয়ে হাজির হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এটি ইউরোপের নিজ অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। ফ্রান্স ও জার্মানির জন্য এ যুদ্ধ কেবল ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের লড়াই নয়। একইসাথে, তা তাদের জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তার সাথে জড়িত। অর্থনৈতিক বিকাশের ভবিষ্যৎ জড়িত।
ইউরোপে জ্বালানির দাম আশঙ্কাজনক মাত্রায় বেড়েছে, খাদ্যপণ্য সরবরাহ নিয়েও সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। কারণ, ইউরোপের ‘রুটির ঝুড়ি’ খ্যাত ইউক্রেনে ইতোমধ্যেই বসন্তকালীন ফসলের আবাদ করা যায়নি। ইউক্রেন থেকে দানাদার শস্য আমদানি বন্ধ থাকার ফলে সরকারি-বেসরকারি মজুদ শেষ হয়ে ইউরোপে দেখা দিবে খাদ্য সংকট”- যোগ করেন চুই।
সে তুলনায় আমেরিকা অনেক দূরের দেশ। ইউক্রেনে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হবে- এমন স্বার্থও নেই। বরং দেশটিকে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ওয়াশিংটন। ফলে যুদ্ধ বাড়লেই মার্কিনীদের উদ্দেশ্যসাধন হয়। আর রাশিয়াকে হঠিয়ে ইউরোপে জ্বালানির প্রধান বিক্রেতার আসনও পাকাপোক্ত করার লক্ষ্য তো রয়েছেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ