করোনা মহামারিকালে রাষ্ট্রের নানা সঙ্কটের মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বছরের বিভিন্ন সময়ে। এ সময় করোনা মহামারির কারণে রাষ্ট্রের নানা সঙ্কটের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমন অভিযোগ করেছে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
গত তিন বছরে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, কথিত বন্ধুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারসহ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৬টি জেলার ৫৯১ জন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সিজিএস বলছে, এই ৫৯১ জনের মধ্যে ৮৬ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে কথিত বন্ধুকযুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি এসব ঘটনায় জড়িত ছিল বলে মন্তব্য করেছে সিজিএস।
‘নির্বিচার প্রাণনাশ? বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আজ শনিবার সকালে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং সিজিএসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ড. আলী রীয়াজ। সাতটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের আলোকে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে ২৫৯টি হত্যাকাণ্ডে পুলিশ এবং ১৬২টি হত্যাকাণ্ডে র্যাব জড়িত ছিল। আর বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ব্যক্তির সংখ্যা কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি, ২৩৮ জন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৯১ ব্যক্তি। এর মধ্যে ২০২০ সালের জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি ৪৯ জন মারা গেছে। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যার ৮৬ দশমিক ৬৩ শতাংশই ছিল বন্ধুকযুদ্ধ। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৬টিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কক্সবাজার জেলায় মারা গেছে সবচেয়ে বেশি ২৩৮ জন। আর ঢাকাতে এরকম ঘটনা ঘটেছে ৫৮ জনের সঙ্গে।
সিজিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ৪৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ ঘটনায় পুলিশ এবং ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ ঘটনার র্যাব জড়িত ছিল। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২১২ জন, র্যাবের সঙ্গে ১৬৫ জন, বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে ২০১৯ সালে বন্ধুকযুদ্ধে মারা যান ৩০৬ জন। গবেষণার এ সময়ে সর্বশেষ গত বছরের ১২ ডিসেম্বরে সাতক্ষীরায় পুলিশি হেফাজতে বাবলু সরকার নামে এক ব্যক্তি মারা যান। আর সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি কুমিল্লা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা সাইফুল নামের এক ব্যক্তি।
এই সব ঘটনায় র্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ছে। নিষেধাজ্ঞার পর দুজন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। তবে রাষ্ট্র ও সমাজ টিকে থাকলে এগুলোর বিচার করতেই হবে।’
প্রতিবেদনে এই সংকট মোকাবিলায় স্বাধীন কমিশন গঠন করে গত এক দশক ধরে চলা এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা বন্ধসহ ৫ দফা সুপারিশ করা হয়।
ওয়েবিনিয়ারে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘বোঝাই যায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। শুধু নির্বাচনই নয় বিভিন্ন উৎসবের সময়েও লোকদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যারা এগুলোর সঙ্গে জড়িত তাঁরা পদক, পদোন্নতি পান। তাই তারা আরও বেশি এ কাজটা করেন।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক ওয়েবিনারে বলেন, ‘এই সব ঘটনায় র্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ছে। নিষেধাজ্ঞার পর দুজন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। তবে রাষ্ট্র ও সমাজ টিকে থাকলে এগুলোর বিচার করতেই হবে।’
সিজিএসের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে বিচারিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড। সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি কোনো অপরাধ করলে সে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে, সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারবে। এটি তার মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেখানে বিচারের আগেই আইনের তোয়াক্কা না করে অভিযুক্তকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে।
তারা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
আরও বলেন, সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।
তারা বলেন, গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ