ঘনত্বের দিক থেকে একসময়ে বিশ্বের সবচেয়ে গভীর অরণ্য হিসাবে বিবেচনা করা হত আমাজনকে। চিরহরিৎ বৃক্ষের আধিক্যে সেখানে দিনের বেলাতেও মাটি স্পর্শ করতে পারত না সূর্যালোক। কিন্তু ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে সেই সবুজের সামিয়ানা।
এমনকি এই শতকের শেষে আমাজন সম্পূর্ণভাবে পরিণত হতে পারে সাভানায়। সম্প্রতি এমনই আশঙ্কার কথা শোনালেন গবেষকরা! প্রসঙ্গত, সাভানা হচ্ছে ঘাস-বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের মিশ্রণে তৈরি একটি বাস্তুতন্ত্র। এখানে অসংখ্য বৃক্ষ পাশাপাশি অবস্থান করে কিন্তু খুব বেশি কাছাকাছি থাকেনা। এর ফলে যে চাঁদোয়া সৃষ্টি হয় তা খুব ঘন হয় না। চাঁদোয়ার মধ্য দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যের আলো মাটিতে পড়ে। ফলে সহজেই ঘাস জন্মাতে পারে।
ব্রিটেনের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্লোবাল সিস্টেম ইনস্টিটিউটের গবেষকরা যৌথভাবে এই গবেষণা চালিয়েছিলেন আমাজনের স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর। আর তাতেই উঠে আসে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য। একুশ শতকের শুরু থেকে বিগত ২১ বছরের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই এই গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন তারা।
মূলত, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে উপর থেকে সংগৃহীত হয়েছিলেন আমাজনের সবুজ সামিয়ানার ছবি। সেই ছবি বিশ্লেষণ করতেই দেখা যায় ধারাবাহিকভাবে ক্রমশ কমছে সবুজের আধিক্য। হ্রাস পাচ্ছে বৃক্ষের সংখ্যা।
পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত ব্রাজিলের আমাজন ধ্বংস গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে গত বছর বলে জানিয়েছে দেশটির মহাশূন্য গবেষণা সংস্থা।
সংস্থাটি জানায়, গত এক বছরে বন উজাড় করার হার ২২ শতাংশ বেড়েছে। দেশটির সরকারি তথ্যানুযায়ি ২০২০-২১ সালে এই বনের প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা ধ্বংস হয়েছে যা ২০০৬ সালের পর সবচেয়ে বেশি।
নভেম্বরের শুরুতে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংস বন্ধ করে নতুন নতুন বনায়নের প্রতিশ্রতি দেয়া দেশগুলির মধ্যে ব্রাজিল অন্যতম।
আমাজন ধ্বংসের মাত্রা প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারোর শাসনামলে বেশি বেড়েছে। বন উজার করে নগরায়নের পক্ষে তিনি। বন ধ্বংসের জেরে ব্রাজিলের মহাশূন্য সংস্থার সাথেও বিবাদ রয়েছে তার।
অবশ্য তার একমাত্র কারণ বৃক্ষচ্ছেদন নয়, বরং খরা। হ্যাঁ, পৃথিবীর অন্যতম আর্দ্র জলবায়ুপূর্ণ অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও বিগত দু’দশকে ভয়াবহ খরা এবং দাবানলের শিকার হয়েছে আমাজনের রেইন-ফরেস্ট।
সেইসঙ্গে অবৈধ খাদান আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে পৃথিবীর ফুসফুসকে। সিসা, ক্যাডমিয়াম এবং পারদের মতো পদার্থের উপস্থিতির কারণে বিষক্রিয়ার শিকার আমাজন অরণ্য।
গবেষকদের দাবি, ইতিমধ্যেই স্থিতিস্থাপকতার চরম মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে আমাজন। ফলে আর কোনোভাবেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারছে না বিশ্বের ঘনতম অরণ্য। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে ‘নো রিটার্ন পয়েন্ট’।
প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ক্ষতের পরিমাণ। এভাবে চলতে থাকলে অল্পদিনের মধ্যেই আমাজন পরিণত হবে সাভানায়। গবেষকদের আশঙ্কা এমনটাই।
আমাজন শুধুমাত্র পৃথিবীর সর্বোচ্চ অক্সিজেন সরবরাহকারী অরণ্যই নয়, পৃথিবীর অন্যতম কার্বন সিঙ্কও বটে। পাশাপাশি আমাজনের গহীন অরণ্য বহু বহু প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। আমাজন সাভানায় পরিণত হলে, বছরে প্রায় ৯০ বিলিয়ন টন কার্বন বর্জ্যের পরিমাণ বাড়বে পৃথিবীর বুকে।
পাশাপাশি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাস্ততন্ত্রও। আশ্চর্যের বিষয় হল এখনও পর্যন্ত ব্রাজিল কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয় আমাজনের এই সমূহ বিপদ সম্পর্কে!
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ