ইতিহাস বিখ্যাত রানী সপ্তম ক্লিওপেট্রা ফিলোপেটর ছিলেন মিশরের টলেমাইক সাম্রাজের শেষ সক্রিয় শাসক। তিনি তার ঘটনাবহুল জীবনের জন্য ইতিহাসে কুখ্যাতি পেয়েছেন। তবে তার ৩৯ বছরের জীবন যতটা নাটকীয় ছিল তার থেকে বেশি আলোচনা জন্ম দেয় তার মৃত্যু রহস্য।
বাবা দ্বাদশ টলেমি আওলেটেসের সঙ্গে তিনি দ্বৈতভাবে মিশর শাসন করতেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তার ভাতৃদ্বয় ত্রয়োদশ টলেমি ও চতুর্দশ টলেমির সঙ্গে রাজ্য শাসন করতেন। সে কালে মিশরে ভাই-বোন বিয়ে প্রচলিত ছিল। তৎকালীন মিশরীয় ঐতিহ্য অনুসারে তিনি আপন দুই ভাইকে বিয়েও করেছিলেন। পরবর্তীতে একসময় ক্লিওপেট্রা মিশরের একক শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। ফারাও হিসেবে তিনি রোমের শাসক গাউস জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন যা মিশরের সিংহাসনের উপর তার হাতকে আরো শক্তিশালী করেছিল।
রোমে সিজার ক্লিওপেট্রাকে অত্যন্ত সম্মানিত আসন দান করেন। এমনকি ভেনাসের মন্দিরে ক্লিওপেট্রার একটি স্বর্ণমূর্তিও স্থাপন করা হয়। সিজারের আকস্মিক মৃত্যুর পর মার্ক অ্যান্টনি অল্প বয়স্ক অক্টাভিয়াসকে বেকায়দায় রেখে রোমের শাসনভার গ্রহণ করেন। বুদ্ধিমতী ক্লিওপেট্রা এবার মার্ক অ্যান্টনিকে নিজের কবজায় আনার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন। ২৮ বছরের সুন্দরী ক্লিওপেট্রার মোহনীয় সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তার কাছে ধরা দেন সম্রাট মার্ক অ্যান্টনি।
ক্লিওপেট্রার মোহে বন্দি রোমান সম্রাট অ্যান্টনি ঘোষণা করেন, মিশর রোমের করদরাজ্য নয়, বরং মিশর একটি স্বাধীন দেশ। আর ক্লিওপেট্রা এ দেশের রানি। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬ সালে তারা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। এটি ছিল একটি চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা। ক্লিওপেট্রাকে খুশি করতে ৩৪ সালে তিনি মিশর, সাইপ্রাস, ক্রিট, সিরিয়ার শাসনমতা ক্লিওপেট্রাকে দান করেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩১ সালে অ্যান্টনি গ্রিসে তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী অক্টাভিয়াসের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যান। ফলে রোমের শাসন ক্ষমতা চলে যায় অক্টাভিয়াসের কাছে। সেই সঙ্গে ক্লিওপেট্রার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়লেন অ্যান্টনি। অক্টাভিয়াসের ক্লিওপেট্রা তার মায়াজালে বন্দি করতে যেয়ে অ্যান্টনিকে সুকৌশলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন। অ্যান্টনি মৃত্যুবরণ করলেও অক্টাভিয়াসকে হাত করার অপপ্রয়াস পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। অক্টাভিয়াস ক্লিওপেট্রাকে জীবিত চায়। অক্টাভিয়াস কাছে আরো অপমানিত হবার চেয়ে মৃত্যুই তার কাছে শ্রেয় মনে হলো।
তাই তদানীন্তন রাজকীয় প্রথা হিসেবে অ্যাস্প নামের এক বিশেষ ধরনের সাপের ছোবলে ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেন। তবে ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর কারণ হিসেবে আত্মহত্যাকে উল্লেখ করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয়েছে এমনটা প্রচলিত রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ছোটখাট ভাইপার কিংবা মিশরীয় গোখরার ছোবলে তার মৃত্যু হয়েছিল।
আর এর সপক্ষে যুক্তি হচ্ছে, ভাইপারগুলো মিশরে রাজকীয়তার ধারক হিসেবে বিবেচিত হত। ফলে প্রাসাদে এগুলো সংরক্ষণের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। অন্যদিকে, ক্লিওপেট্রা যে দেবীর (আইসিস) পূজা করতেন, মিশরীয় গোখরা ছিল তার প্রিয় সাপ।
কিন্তু এই মতবাদের বিপক্ষেও কথা বলছেন আধুনিক মিশরীয় গবেষকরা। তাদের মতে, সাপের কামড়ে রানীর মৃত্যু হয়েছে এটি সহজেই প্রমাণ করার মতো নয়। গোখরা সাপ কমপক্ষে ৫ ফুট লম্বা হয় এবং বড়সড় আকৃতির হলে ৮ ফুটের কম কখনোই হয় না। যারা সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে মত দিয়েছেন তারা আরও বলেছেন সাপটি রানীর কক্ষে একটি খাবারের ঝুঁড়িতে লুকিয়ে ছিল। আবার এটাও উল্লেখ করা হয়েছিল যে খাবারের ঝুঁড়িতে ফলমূল সংরক্ষণ করা হতো। কারো কারো মতে ঝুঁড়িতে শূকরের মাংস ছিল। আর এই বাক্সটি একটি গোখরা সাপ লুকিয়ে থাকার জন্য কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। এছাড়াও ছোট আকৃতির গোখরা সাপের কামড়ে সরাসরি মৃত্যু হয় না। বরঞ্চ এর মাঝে চিকিৎসকদের ডাকার সময়-সুযোগও পাওয়া যায়।
মিশরের ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, একটি সাপ একসঙ্গে ক্লিওপেট্রা এবং তার দুই দাসীকে হত্যা করেছে। তা-ও আবার রানীর পাঠানো চিরকুটটি অক্টাভিয়ানের নিকট পৌঁছানোর পর প্রহরীরা ক্লিওপেট্রার দরগাহে আসতে যে অল্প সময়ে অতিবাহিত হয়েছিল তাতে এই বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবেও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। আর সাপের কামড়ে যদি তার মৃত্যু না-ও হয়ে থাকে, তবে মৃত্যুর আসল কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদরা কী ভাবছেন সেটি জানা জরুরি।
ক্লিওপেট্রা বিষাক্ত কিছু গ্রহণ করে আত্মহত্যা করেছেন এমনটা মানতে রাজি নন ইতিহাসবিদ স্ট্যাসি মেডেলিন। অন্যদিকে, প্রাচীন লেখক স্ট্রাবো জীবদ্দশায় রানীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে অতিরিক্ত মদ এবং ভেষজ মিশ্রণের সঙ্গে বিষাক্ত ঔষধ মিশিয়ে পান পান করাকে দায়ী করেন। অন্ততপক্ষে বিষপানে তিনি এবং তার দাসীরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃত্যুবরণ করার বিষয়টি বিশ্বাস করা যায়।
২০১০ সালে জার্মান ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার শেফার দীর্ঘদিন গবেষণা করে বলেন, ক্লিওপেট্রার মৃত্যু হয়েছিল হেমলক, বিষাক্ত নীল ফুল এবং আফিমের মিশ্রণ গ্রহণ করার ফলে। প্রাচীন নথির তথ্যানুযায়ী তিনি একজন টক্সিকোলজিস্টের সঙ্গে গবেষণা করে এমন বিবৃতি দেন।
যা-ই হোক, সত্য আজও অজানাই রয়ে গেছে। কারণ নিজের চোখে ক্লিওপেট্রার মৃত্যু দেখেছেন এমন কারো বিবৃতি আজ অবধি খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর সন্দেহের তীর বরাবরই অক্টাভিয়ানের দিকেই তাক করেন ইতিহাসবিদরা। যুদ্ধে জয়লাভের বছরখানেক পর আলেকজান্দ্রিয়ায় তার আগমন এবং মিথ্যা সংবাদের ভিত্তিতে মার্ক অ্যান্টনির আত্মহত্যা পর্যন্ত তদন্ত করলেও সরাসরি সন্দেহের চোখে তিনিই থাকতেন। আর যদি ক্লিওপেট্রাকে কেন অক্টাভিয়ান হত্যা করবেন সেই প্রশ্ন করা হয় তবে উত্তরটি খুব সহজেই বের করা সম্ভব।
অক্টাভিয়ান রানীকে নিজ হাতে হত্যা করুন বা না করুন, তিনি যে তাকে হত্যার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন এটি সুস্পষ্ট। এছাড়াও শুধুমাত্র ক্লিওপেট্রাকে হত্যা করলেই তিনি মিশরকে নিজের আয়ত্তে নিতে পারতেন না। বরঞ্চ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তার বড় ছেলে সিজারিয়নকেও হত্যা করতে হতো। ফলশ্রুতিতে তার নির্দেশে সিজারিয়ানকে হত্যা করা হয়। সিজারিয়ানকে হত্যার পেছনে আরও একটি বড় কারণ উল্লেখ করেন ইতিহাসবিদরা। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এবং ক্লিওপেট্রার গুপ্ত প্রেমের সাক্ষী তাদের একমাত্র সন্তান। অন্যদিকে, অক্টাভিয়ানও ছিলেন সিজারেরই সন্তান।
ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর মিশরে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কেউ বেঁচে নেই এমনটা প্রমাণ করে অক্টাভিয়ান মিশরকে রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেও রোমান সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে সিংহাসনে বসেন। সেই সাথে নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন অগাস্টাস। সম্রাট অগাস্টাস সর্বপ্রথম মার্ক অ্যান্টনিকে হত্যা করে রোমান সাম্রাজ্যের সেরা সেনাপতি হিসেবে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলেন। অতঃপর পথের কাঁটা ক্লিওপেট্রা এবং তার সন্তানকে হত্যা করে মিশর তথা রোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনও পাকাপোক্ত করে নেন সিজারপুত্র।
এসডব্লিউ/এসএস/২২১০
আপনার মতামত জানানঃ