রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধের খবরাখবর জানানো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের খোলামেলা বর্ণবাদী মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেতে হয়। ইউরোপে সীমান্তরক্ষীরা যেভাবে শরণার্থীদের আটকে দিচ্ছেন এবং সরাসরি বর্ণবিদ্বেষী আচরণ করছেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক শুদ্ধতার আবরণে ঠিক কীভাবে ছড়িয়েছে বর্ণবাদ।
ইউক্রেন বনাম ইরাক-ফিলিস্তিন-আফগানিস্তান
রুশ বাহিনীর আগ্রাসী আচরণের নিন্দায় সরব যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডার মতো দেশগুলো। সেসব দেশের মিডিয়াতে রীতিমতো ধুয়ে ফেলা হচ্ছে ভ্লাদিমির পুতিন ও তার বাহিনীকে। ভুক্তভোগী ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঝড় বইয়ে দিচ্ছে পশ্চিমারা। অথচ এই দেশগুলোই ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া যুদ্ধের ক্ষেত্রে চোখে যেন টিনের চশমা পরে থাকে। আজ ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ রুশ আক্রমণ ঠেকাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিলে তাদের ‘বীর মুক্তিকামী যোদ্ধা’ বলছে পশ্চিমারা, অথচ ফিলিস্তিনের মানুষ হাতে গুলতি ওঠালেও তা তাদের কাছে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হয়ে যায়। ইউক্রেন যুদ্ধ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পশ্চিমারা কতটা ‘হিপোক্রেট’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালো জীবন যখন মাত্রই বিবেচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের কালো জীবন, ক্কচিৎ কদাচিৎ বিবেচনার বিষয় হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে যে রুয়ান্ডায় গণহত্যার সময় পৃথিবী কতটুকু আদৌ পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং সত্যি বলতে কিছুই করেনি। দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ বা কিভু যুদ্ধ থেকে আমরা খুব বেশি হলে কিছু মানবিক গল্প পেয়েছি। এই যুদ্ধ ছিল মূলত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আফ্রিকীয় সংস্করণ, এবং এই যুদ্ধে বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে জড়িত বিভিন্ন পক্ষকে সমর্থন দেওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
গুগল সার্চ না করে আপনারা ক’জন আসলে দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ, ইতুরি যুদ্ধ এবং কিভু যুদ্ধ সম্পর্কে শুনেছেন বা জেনেছেন বা বলতে পারবেন? আমার ধারণা বলতে গেলে কেউই কিছু বলতে পারবেন না। একইভাবে সারা বিশ্বের ‘বাদামি ত্বকে’র মানুষদের সম্পর্কে আমরা বলতে গেলে কোনো সহানুভূতি-ই দেখতে পাই না- সত্যি বলতে এই চলতি হ্যাশট্যাগের সময়ে একটি ‘বাদামী জীবন’ও সাদা পৃথিবীর বিবেচনার বিষয় নয়।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, এমএসএনবিসি ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত সব ভয়ানক নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেছে যা কিনা ইরাকে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যুর কারণ হয়েছে। এর সঙ্কীর্ণতম চেহারা আমরা দেখতে পাই যখন উদারনৈতিক গণমাধ্যমের পছন্দের মানুষ এবং অযোগ্যতার জন্য কুখ্যাত ও স্মরণীয়ভাবে দূর্নীতিগ্রস্থ ‘কূটনীতিক’ ম্যাডেলিন অলব্রাইট- ক্লিন্টন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠতম মিত্রদের সৃষ্ট এই রাজনীতিককে জিজ্ঞাসা করা হয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে তার মেয়াদকালে ‘আমাদের দেশ কি ইরাকে মানবিক সাহায্য দিচ্ছে না- মৃত্যু?’
নাজি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা বন্দী শিবিরের রক্ষীর মত তার উত্তর ছিল, ‘সাদ্দাম হোসেনের চেয়ে ইরাকের মানুষের জন্য আমরা বেশি মমতা বোধ করে থাকি।’ বর্তমানে তিনি একজন সেলিব্রিটি মিডিয়া আলোচক এবং তিনি নিজেই তার কোম্পানিটি পরিচালনা করেন যা মার্কিনী ব্যবসায় স্বজনপ্রীতিমূলক সংযোগ বিষয়ে তাঁর এই কোম্পানিটি কাজ করে।
পাশাপাশি তুলনা করুন আজ ইউক্রেনে বোমা হামলার প্রেক্ষিতে সারা বিশ্ব জুড়ে যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে তার মাত্রা বা পরিসরকে! ইউক্রেনে এখনো পর্যন্ত ২০০’র বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়নি- যা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় মার্কিনী আক্রমণ, দখল ও হামলায় সূচীত মৃত্যুর ভগ্নাংশও নয়।
১৯৬০ ও ‘৭০-এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের যে বহু-জাতিত্বমূলক প্রকৃতি দেখা দেয় তার প্রেক্ষিতেই ইহুদিদেরও ইতালীয় ও আইরিশদের মত সম্মান সূচক ‘শ্বেতকায়’ মর্যাদা দেওয়া হয়। ঘটনাক্রমে, ‘সম্মানসূচক শ্বেতকায়’ কোন বানানো শব্দ নয়- দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনকালে এটি ছিল একটি ‘আইনী’ শব্দ যা জাপানী, তাইওয়ানী এবং দক্ষিণ কোরীয় ব্যবসার সুযোগ বা অভিগম্যতা পাবার জন্য তৈরি করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবহৃত এই আইনী পরিভাষাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘অবর্ণিত বাস্তবতা’ হয়ে দাঁড়ায়।
বছরের পর বছর ধরে নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের বর্বরোচিত আচরণের খবর পশ্চিমের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই প্রচার হয়। তবে কিছুটা ভিন্নভাবে। তাদের ‘প্রচার স্টাইলে’ আগ্রাসনবাদীর শক্তি প্রয়োগ অনেকটাই আড়াল করে রাখা হয়। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে পশ্চিমা মিডিয়ার খবর ও নেতাদের কথাবার্তায় দখলদারি, গুলি করে হত্যা, গুলিবর্ষণ এবং বোমা হামলার মতো ঘটনাগুলোতে ‘ক্ল্যাশ’ (সংঘর্ষ), ‘কনফ্লিক্ট’ (সংঘাত) ও ‘প্রোপার্টি ডিসপুট’র (সম্পত্তি বিরোধ) মতো শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ ধরনের ‘প্যাসিভ ভয়েস’র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘কারণ’ বা ‘টার্গেট’ চেপে যাওয়া হয়।
কিন্তু এখন ইউক্রেন সংঘাতের ক্ষেত্রে তারা ঠিকই ‘অ্যাগ্রেসন’ (আগ্রাসন), ‘ইনভেশন’ (আক্রমণ), ‘অ্যাটাক’ (হামলা), ‘কিল’ (হত্যা), ‘ইলিগ্যাল স্টেপ’ (অবৈধ পদক্ষেপ)-এর মতো শব্দ ব্যবহার করছে, যা ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও হওয়ার কথা ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, এতদিন ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, তাদের জমি কেড়ে নেওয়া সেই ইসরায়েলই আজ রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছে, তাদের শান্তি বজায় রাখতে বলছে।
রুশ আক্রমণের মধ্যে ইউক্রেনীয়দের আরও একটি বিষয় সামনে আসছে, তা হলো ‘বর্ণবাদী আচরণ’। বিবিসি, আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর এসেছে, যুদ্ধের কারণে দেশত্যাগে আগ্রহীদের বেছে বেছে সীমান্ত পার করাচ্ছে ইউক্রেন। কৃষ্ণাঙ্গদের ট্রেনে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ভারতীয় শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার ভিডিও পর্যন্ত সামনে এসেছে।
যে ইউক্রেন বিদেশিদের সীমান্ত পার হতে বাধা দিচ্ছে, তারাই আবার নিজেদের রক্ষা করতে বিদেশিদের কাছেই বারবার আকুতি জানাচ্ছে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিমাদের কাছে। পশ্চিমারাও তাতে গলে যাচ্ছেন। সাদা চামড়া-নীল চোখের ইউক্রেনীয়দের জন্য মুখে মুখে হলেও প্রতিবাদের ঝড় তুলছেন তারা, যা ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লিবিয়ার ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায়নি।
বর্ণবাদী পথে বিবিসি
এ্যালান ম্যাকলিয়ড, একজন নিরপেক্ষ গণমাধ্যম বিশ্লেষক, সংবাদমাধ্যম থেকে নানা মন্তব্য সঙ্কলন করে একটি থ্রেডে নিয়ে এসেছেন: বিবিসিতে একজনকে কথা বলতে দেখানো হয় যিনি বলছিলেন যে তিনি কেন ‘সোনালী চুল ও নীল চোখের শ্বেতাঙ্গদের বোমা হামলার শিকার হতে দেখে মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত বোধ করছেন। সিবিএস-এর এক প্রতিবেদক দাবি করেন যে তিনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বোধ করছেন যেহেতু ‘এটা ইরাক বা আফগানিস্তান নয়…এটা তুলনামূলকভাবে সভ্য, তুলনামূলকভাবে ইউরোপীয় এক শহর।’
বিবিসি-র প্রাক্তন সাংবাদিক ও বর্তমানে আল জাজিরায় কর্মরত সাংবাদিক পিটার ডোব্বি বলেন, ‘সবচেয়ে যেটা মনের উপর চাপ সৃষ্টিকারী সেটা হলো এদের দিকে তাকানো, এদের পোশাকের ধরণ। এরা সবাই স্বচ্ছল, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এরা স্পষ্টত: মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকা থেকে পালানোর চেষ্টা করতে থাকা উদ্বাস্তুরা নয়। এরা যে কোন ইউরোপীয় পরিবারের মত দেখতে যারা তোমার পাশের বাসায় থাকে।’
সবচেয়ে বেশি বিষ্মিত করেছে অতিরিক্ত সোচ্চার এনবিসি, ‘খুব মোটা দাগে বললে, এরা সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থী নয়, এরা ইউক্রেনের শরণার্থী…তারা খ্রিষ্টান, তারা শ্বেতকায়। তারা আমাদের সাথে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ।’
বিবিসির অর্থায়ন হয় যুক্তরাজ্যে বসবাসকারীদের দেওয়া কর থেকে। আর, যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণকারীদের মধ্যে বাদামি, কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্যান্য বর্ণের মানুষের অভাব নেই। যুক্তরাজ্যের সম্প্রচারমাধ্যম বিবিসিকে প্রজ্ঞা ও সাম্যের প্রচারক হিসেবে দেখা হয়। সেই বিবিসি যখন বর্ণবাদী পথে হাঁটে, তখন তাকে হতাশাজনক বললেও কম বলা হয়।
সিবিএসের খ্যাতিমান সংবাদদাতা চার্লি ডি আগাতা বলেছেন, ‘ইরাক বা আফগানিস্তান নয়, (ইউক্রেন) একটি সভ্য ইউরোপীয় শহর।’ বিবিসির মতো সিবিএসও চার্লির এমন ঢালাও বর্ণবাদী মন্তব্যের সমালোচনা করার প্রয়োজনবোধ করেনি।
এবার আলজাজিরার এক সাংবাদিক কী বলছেন, শোনা যাক—‘তাদের পোশাকের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। (বোঝাই যায়) তারা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত। তারা তো আর মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকা থেকে পালানোর চেষ্টারত শরণার্থী নয়। তারা দেখতে আপনার পাশের বাসার যেকোনো ইউরোপীয় পরিবারের মতো।’
বিএম টেলিভিশন ফ্রান্স আরও বাজেভাবে বলছে—‘আমরা একুশ শতকের একটি ইউরোপীয় শহরে রয়েছি। এবং এমন ক্ষেপণাস্ত্র-হামলা দেখছি, যেন আমরা আফগানিস্তান বা ইরাকে রয়েছি। আপনি ভাবতে পারেন!’
হ্যা, পারি বইকি! আফগানিস্তান আর ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলোই। ভুয়া রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের অজুহাতে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বে নির্বিচারে হামলা চালানো হয়েছে।
তবে, (ইউক্রেন-রাশিয়া) ইস্যুতে পশ্চিমা ইউরোপীয় গণমাধ্যম ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করবে—তা কিন্তু ভাবাও যায় না।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ