করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি ক্রমে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। দেশি-বিদেশি বাণিজ্য সচল হচ্ছে। এই স্বাভাবিকতার সময়ে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। থমকে থাকা বাজার যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। করোনায় বিধ্বস্ত নিম্ন-আয়ের মানুষের নিকট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যেন ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়ে উঠেছে।
বাজারে বেশ কিছুদিন ধরে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা এবং আসন্ন রমজান ঘিরে অসাধু ব্যবসায়ীরা তেল মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। তাদের অতিমুনাফার লোভে তেলের দামও বাড়ছে হু-হু করে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে দেশি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো হঠাৎ করেই তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। কোম্পানি থেকে ডিলার ও পাইকারি বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। বোতলজাত তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ২ ও ৫ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল বাজার থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী ২ মার্চ ঘোষণা দিয়েছেন ভোগ্যতেলের দাম বাড়বে না; ব্যবসায়ীদের দাম বৃদ্ধির দাবি সরকার নাকচ করে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই সিন্ডিকেট করে সরবরাহ কমিয়ে ভোগ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে প্রতিটি এলাকায় ভোগ্যতেলের দাম বেড়েছে।
ভুক্তোভোগীরা বলছেন, বাজারে সরকারের তেমন নজরদারী নেই। মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে দু’চারজনের জরিমানা করে মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। বাস্তবে কোথাও তদারকী নেই।
বাজারে সরকারের তেমন নজরদারী নেই। মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে দু’চারজনের জরিমানা করে মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। বাস্তবে কোথাও তদারকী নেই।
সরবরাহ সংকটের কারণে গত বুধবারের তুলনায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম গড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। হাতিরপুল ও নিউমার্কেটে প্রতি লিটার ১৮৫ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২ লিটারের দাম ৩৩৫ থেকে ৩৪০ এবং ৫ লিটারের দাম ৭৯০ থেকে ৮০০ টাকা। তারপরও অনেক দোকানে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রাবাড়ি, ফকিরের পুল বাজারে একই চিত্র।
দোকানের সেলফে তেল না থাকা প্রসঙ্গে নিউমার্কেটের হোসেন স্টোরের বিক্রয়কর্মী মো. আরিফ বলেন, কোম্পানিগুলো চাহিদা মতো তেল দিচ্ছেন না, তাই দোকানে তেল নেই। প্রতিদিন ১, ২ ও ৫ লিটার মিলিয়ে ৮০০ থেকে হাজার লিটারের চাহিদা থাকলেও কোম্পানি থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ লিটারের বেশি দিচ্ছে না। একই দোকানে সদাই করতে আসা সাইদুল নামের একজন ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, তেল লুকিয়ে রাখা হয়েছে বাড়তি দামে বিক্রির আশায়। ফলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
শনির আখড়ার মসজিদ রোডের মনির স্টরের মালিক মো. মনির হোসেন বলেন, হঠাৎ করে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে চাহিদার তুলনায় পণ্য কম থাকলে দাম বাড়বেই। পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও কমানো নির্ভর করে মোকামে কেমন দাম তার উপর।
জানা গেছে, রমজান আসছে সে কারণে কয়েকদিন ধরে সয়াবিন তেলের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ও পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে ঊর্ধ্বমুখী। অথচ এসব বাজারে তেলের সরবরাহে কোনো কমতি নেই।
এদিকে ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তারা প্রতি টন ১ হাজার ৭৩০ ডলারে কিনছেন। এক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনার মূল্যের পার্থক্য হচ্ছে ২৪৮ ডলার।
গত বুধবার বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের জানান, তার মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য আছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা ভোজ্যতেলের মজুত গড়েছেন। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বাজারে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। সরকারি একাধিক সংস্থা তদারকিতে নেমেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে রিফাইনারি কোম্পানিগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটারে খোলা সয়াবিনের দাম ৭ টাকা এবং বোতলজাত তেলের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়ানো হয়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে তারা ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে প্রতি লিটারে আরও ১২ টাকা বাড়ানের প্রস্তাব করে। বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়।
তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি লিটার তেলে ৮টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দর নির্ধারণ করা হয় ১৪৩ টাকা, বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন ১৬৮ টাকা ও বোতলজাত পাঁচ লিটারের সয়াবিন ৭৯৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গত দুতিন দিন থেকে আরো বাড়তি দামে ক্রেতাদের ভোগ্যতেল কিনতে হচ্ছে।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও রমজান মাসকে সামনে রেখে ভোগ্যপণ্য নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন দেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের মূল্যবৃদ্ধির হারকেও ছাপিয়ে গেছেন তারা। শুধু তাই নয়, শিগগিরই বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে পারে-এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হচ্ছে ওই ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশের বাজারে আজকে কোনো পণ্যের মূল্য বাড়লে তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়তে অন্তত দুই থেকে আড়াই মাস লাগে। কিন্তু দেশি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থেকে মনে হয়, আড়াই মাস পরে তো দূরের কথা, দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে সেটি কার্যকর করা হচ্ছে। শুধু কার্যকর নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি বাড়ানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনার আতঙ্কের মধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। করোনার কারণে আজ অনেকেরই চাকরি নেই, অনেকের ব্যবসা বন্ধ। কেউ বেকার ও নিঃস্ব হয়ে অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছে। কেউ আবার তার ভালো চাকরিটি হারিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে। দিনমজুর হয়ে কাজ করতেও অনেকে বাধ্য হচ্ছে শুধু পেটের তাগিদে; পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটুখানি খেয়ে-পরে বাঁচার আশায়। অবশ্য এ কষ্ট, এ যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। হয়তো যারা অকারণে খেয়াল-খুশিমতো এভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছেন, তারা বুঝতেও চান না সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা। সবার মধ্যেই যেন আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার স্বপ্ন বিরাজ করে সারাক্ষণ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে এমন অবস্থা তো মেনে নেওয়া যায় না। দ্রব্যমূল্যের মনগড়া বৃদ্ধি অবশ্যই আমাদের ঠেকাতে হবে, কঠিন আইনের মাধ্যমে অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে এ নোংরা খেলা।
তারা বলেন, মহামারি করোনা এরই মধ্যে আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আমাদের অনেককে নিঃস্ব করে দিয়েছে। কমবেশি সবার মধ্যেই পড়েছে এর নেগেটিভ প্রভাব। অনেকে সবকিছু হারিয়ে অর্থকষ্টে দিনযাপন করছে। অন্তত সাধারণ জনগণের কথা ভেবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর যেন ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা হয় এবং তা যেন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সহনশীল মাত্রায় মূল্য নির্ধারণের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণকারীদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৫৫
আপনার মতামত জানানঃ