ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগর তীরের একটি বন্দরে যে বাংলাদেশি জাহাজটি ২৯ জন বাংলাদেশি নাবিকসহ আটকে পড়েছিল, সেই জাহাজে রকেট হামলায় একজন বাংলাদেশি নাবিক মারা গেছেন।
রকেট হামলায় জাহাজটিতে আগুন ধরে গিয়েছিল, কিন্তু জাহাজের ক্রুরা দ্রুত সেই আগুন নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হন।
অলভিয়া সমুদ্রবন্দরে আটকা পরা বাংলাদেশের জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রকেট হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সময় গতকাল রাত প্রায় ৯ টা ২৫ মিনিটে জাহাজের ব্রিজে রকেট হামলা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাহাজে থাকা নাবিক সালমান সামি।
তিনি বলেন, রকেট হামলায় জাহাজে আগুন ধরে যায়। এসময় সবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আগুন নেভানো গেছে। হামলায় আমাদের সঙ্গী হাসিদুর রহমান নিহত হয়েছেন, বাকিরা সবাই সুস্থ আছেন।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমোডর সুমন মাহমুদ সাব্বির বলেন, ‘আমাদের একজন নাবিক নিহত হয়েছেন। বাকিরা নিরাপদ আছেন।’ কখন ও কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে
তিনি বলেন, ‘কীভাবে হলো তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগে যায়। ঘটনা ঠিক কখন ঘটেছে, সেই প্রতিবেদন আমার আছে আসেনি।’ বাংলাদেশি নাবিকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে বলে জানিয়েছেন কমোডর সুমন মাহমুদ
কমডোর সুমন মাহমুদ জানান, বল ক্লে লোড করার জন্য জাহাজটি গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় বন্দর অলভিয়ার বর্হিনোঙরে পৌঁছায়।
জানা যায়, ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন শুরু হলে জাহাজের মালিকানাধীন কোম্পানি বিএসসি কার্গো লোড প্ল্যান বাতিল করে এবং জাহাজের মাস্টারকে বন্দরে বার্থ না করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়।
তবে, বন্দরের ছাড়পত্র পেতে বিলম্বের কারণে জাহাজটি বন্দর থেকে ছেড়ে যেতে ব্যর্থ হয় এবং রাশিয়ান আক্রমণের পর বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেটি আটকে পড়ে।
বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটির মালিক বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন। গত ২৬শে জানুয়ারি এটি ভারতের মুম্বাই বন্দর থেকে যাত্রা করে এবং তুরস্কের ইরেগলি হয়ে ২২শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌঁছায়।
জাহাজটি বন্দরে পৌঁছানোর পরদিন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হয়। জাহাজটি ইউক্রেন থেকে সিরামিক ক্লে নিয়ে ইতালির রেভেনা বন্দরে যাবার কথা ছিল।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের নির্বাহী পরিচালক পীযূষ দত্ত জানিয়েছিলেন, জাহাজটি ২৩শে ফেব্রুয়ারি অলভিয়া বন্দর ছেড়ে আসার কথা ছিল।
তিনি বলেছিলেন, “কিন্তু এর মধ্যে যুদ্ধাবস্থা শুরু হয়ে যায়, তখন আমরা জাহাজটিকে কোনো পণ্য না নিয়েই বন্দর ছেড়ে চলে আসতে বলি। কিন্তু যেখানে জাহাজটি নোঙ্গর করেছে সেখান থেকে মূল সাগরে আসতে অন্তত ৬০ নটিক্যাল মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে, এবং স্থানীয় পাইলট (পথনির্দেশক) ছাড়া সেটি করা সম্ভব নয়।”
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
বাংলাদেশের নৌ পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরি বলেন, জাহাজের বাকী ২৮ জন ক্রুর সবাই অক্ষত আছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন এবং তারা এখনো জাহাজে আছেন।
জাহাজের ক্যাপ্টেনকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে, তারা জাহাজে থাকবেন, নাকি বেরিয়ে যাবেন।
তবে জাহাজ থেকে বেরিয়ে গেলে খাদ্য সংকট এবং অন্যান্য সমস্যা হতে পারে , সেজন্যে আপাতত জাহাজেই তারা থাকছেন বলে জানা গেছে।
পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ বি এম সুলতানা লায়লা হোসেন বলেন, ‘একজন নিহত হয়েছেন। তবে, বাকিরা নিরাপদে আছেন।’
এ ছাড়া নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলেও জানান তিনি। তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বলতে পারবে। এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা পেলে আমি সেটা বাস্তবায়ন করব।’
এই হামলার পর নাবিক ও দেশে থাকা তাদের স্বজনদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। বেড়েছে উদ্বেগ। প্রশ্ন উঠছে, আর কি দেখা হবে!
ইউক্রেনে অবস্থিত বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের যথাযথ উদ্যোগের অভাব চোখে পড়েছে। এখনও সেখানে আটকে আছে বাংলাদেশি নাবিকেরা। পোলান্ডে যাওয়ার নির্দেশ ছাড়া কার্যত আর কোন পদক্ষেপই নেই সরকারের।
এবার ইউক্রেন জলসীমায় দেশীয় একটি জাহাজের উদ্ধারের কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বন্দরে হামলা হলেই ছিল প্রাণহানির সম্ভাবনা। ঘটেছেও তাই। যুদ্ধ মোড় নিচ্ছে তীব্রতায়। কিন্তু নেই পর্যাপ্ত খাদ্য। আবার খাদ্য ও পানির জন্য জাহাজ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
এমন পরিস্থিতিতে যদি সরকার দেশের বাইরে নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারে, তাহলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কি তার গ্রহণযোগ্যতা হারায় না?
দেশে ফেরার আকুতি
ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দর জলসীমায় গোলা হামলার শিকার বাংলাদেশি জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধি থেকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে দুটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন নাবিকেরা।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে এক নাবিককে বারবার বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের বাঁচান। আমাদের কোনো জায়গা থেকে সাহায্য আসেনি।’
উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে ভিডিও বার্তা দেওয়া এক বাংলাদেশি নাবিক নিজেকে জাহাজের দ্বিতীয় প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দেন।
২৭ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে বাংলাদেশি নাবিককে বলতে শোনা যায়, ‘আমি বাংলার সমৃদ্ধির সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের জাহাজে একটু আগে রকেট হামলা হয়েছে। একজন অলরেডি ডেড। আমাদের পাওয়ার সাপ্লাই নেই। ইমার্জেন্সি জেনারেটরে পাওয়ার সাপ্লাই চলছে। আমরা মৃত্যুর মুখে সম্মুখীন। আমাদের এখনো উদ্ধার করা হয়নি। দয়া করে আপনারা আমাদের বাঁচান। আমরা সবাই আছি এখানে। দেখেন।…আমাদের কোনো জায়গা থেকে সাহায্য আসেনি। আমাদের বাঁচান।’
ছড়িয়ে পড়া এ ভিডিও জাহাজের একটি কক্ষ থেকে করা হয়েছে। সেখানে আরও ১২ নাবিককে দেখা যায়।
ইউক্রেনের বন্দরে আটকে পড়া বাংলার সমৃদ্ধির একজন নাবিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় দুদিন আগে। তখন তিনি দেশে ফেরার তীব্র আকুতির কথা জানিয়েছিলেন।
আতিকুর রহমান মুন্না বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’র ২৯ জন নাবিকের একজন। তিনি জানান, দুশ্চিন্তায় আছেন। কারণ তিনি জানেন না কবে এই আটকে পড়া দশা থেকে মুক্তি পাবেন।
যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত থাকায় বহির্বিশ্বের খবর খুব একটা পাচ্ছেন না। যুদ্ধের বিস্তারিত খুব কমই জানতে পারছেন।
তবে আশপাশে যুদ্ধবিমান উড়তে দেখেছেন তিনি। যেদিন যুদ্ধ বেধেছে প্রথম, সেদিন আকাশ থেকে বোমা ফেলতে দেখেছেন।
যে বন্দরে আটকা পড়েছেন তারা, সেই অলভিয়ার আশপাশে রবিবার তারা অনেক বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছেন। এসব কারণে তাদের সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে।
জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে মাঝে মাঝে বাংলাদেশে পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, শিপিং কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকেও ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে, কিন্তু কীভাবে এই অবস্থা থেকে মুক্ত হবেন তা এখনও জানেন না।
তিনি আরো বলেন, জাহাজে যে খাবার মজুদ আছে তা দিয়ে সব ক্রুর ৪০ দিন পর্যন্ত টিকে থাকা সম্ভব হবে, খাবার পানি আছে প্রায় ১০০ টনের বেশি, তাই আপাতত খাবার ও পানি নিয়ে চিন্তা করছেন না। যত দুশ্চিন্তা দেশে ফিরতে পারবেন তো?
তবে বিদায়ের আগে তিনি আকুতি জানান, “দেশে ফিরতে চাই”।
এসডব্লিউ/এসএস/১১২০
আপনার মতামত জানানঃ