ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনা সমাবেশকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি করেছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো। অসমর্থিত সূত্রের বরাতে আসন্ন যুদ্ধের খবর দিয়ে বড় বড় সংবাদ করেছে তারা। সীমান্তে সেনা মোতায়েন মস্কোর নিয়মিত মহড়ার অংশ হলেও সম্ভাব্য আক্রমণের তারিখ ঘোষণা দিয়েছে পশ্চিমারা। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে যত না মানুষ উত্তেজিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি সংবাদের হেডলাইনে আতঙ্কিত হয়েছে বিশ্ব। তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই একের পর এক গুজব প্রচার করেছে তারা।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশের ধরন নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে দ্বৈত নীতি অনুসরণের (দ্বিমুখী আচরণ) অভিযোগ তুলেছেন। তারা মনে করছেন, সিরিয়া ইয়েমেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তার চেয়ে ইউক্রেন পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। আবার যে ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধকবলিত দেশগুলোর নাগরিকদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হয়, সেই একই ইস্যুতে ইউক্রেনীয়দের মহান হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এমনকি ইউক্রেনীয়দের সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে দেখাতে গিয়ে অন্য দেশের শরণার্থীদের নিয়ে বর্ণবাদী মন্তব্য করতেও দ্বিধা করছেন না পশ্চিমা সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদেরা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ভোরে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। ইউক্রেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রুশ অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত ১৯৮ জন ইউক্রেনীয় নাগরিক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন শিশুও রয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৬০ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় নাগরিক দেশ ছেড়েছেন। এর বেশির ভাগই পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পরপরই এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে বিভিন্ন দেশ। রাশিয়ার ব্যাংক, তেল শোধনাগার ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা শুরু হয়।
পশ্চিমা বিশ্বের এমন আচরণকে দ্বৈত নীতি (দ্বিমুখী আচরণ) হিসেবে দেখছেন অনেকে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশ্ব দ্রুত পদক্ষেপ নিলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংঘাতের ক্ষেত্রে এত দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায় না তারা।
পশ্চিমা বিশ্বের অনেক সংবাদ বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দ্বৈত নীতির ভূমিকা নিয়েছেন। তারা শুধু রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রশংসাই করছেন না, বরং একটি সভ্য দেশে এ ধরনের সংঘাত কী করে হতে পারে, এ নিয়ে তাদের আতঙ্কের কথা তুলে ধরেছেন।
কিয়েভে সিবিএস নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি চার্লি দে আতা শুক্রবার বলেন, ‘পুরোপুরি সম্মান রেখে বলছি, ইরাক ও আফগানিস্তানে দশকের পর দশক ধরে তারা যে ধরনের সংঘাত দেখেছেন, তেমন কোনো সংঘাত হওয়ার জায়গা এটি (ইউক্রেন) নয়। এটি অপেক্ষাকৃত সভ্য, অপেক্ষাকৃত ইউরোপীয়। আর যে শহরে এ ধরনের পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেখানে শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাকে সাবধান হতে হবে।’
পশ্চিমা বিশ্বের অনেক সংবাদ বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দ্বৈত নীতির ভূমিকা নিয়েছেন। তারা শুধু রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রশংসাই করছেন না, বরং একটি সভ্য দেশে এ ধরনের সংঘাত কী করে হতে পারে, এ নিয়ে তাদের আতঙ্কের কথা তুলে ধরেছেন।
তার এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, দে আতার এমন বক্তব্য অশ্বেতাঙ্গ ও ইউরোপের বাইরের মানুষের জন্য আরও ভোগান্তি তৈরি করবে।
দে আতা পরে অবশ্য ক্ষমা চেয়েছেন। বলেছেন, তিনি তার ওই বক্তব্য নিয়ে অনুতপ্ত।
গত শনিবার ইউক্রেনের সাবেক ডেপুটি জেনারেল প্রসিকিউটর ডেভিড সাকভারেলিদজে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেন। তখন তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য খুবই আবেগের বিষয়। কারণ, আমি প্রতিদিন পুতিনের ক্ষেপণাস্ত্র, হেলিকপ্টার ও রকেটের আঘাতে সোনালি চুল আর নীল চোখের অধিকারী ইউরোপীয় মানুষদের মারা যেতে দেখছি।’
ডেভিড সাকভারেলিদজের ওই বক্তব্যের পর বিবিসির উপস্থাপক তখন বলে ওঠেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি এবং অবশ্যই এ আবেগপূর্ণ অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখছি।’
গতকাল রোববার আল–জাজিরার ইংরেজি সংস্করণের উপস্থাপক পিটার ডোবি বলেছেন, ‘যে ইউক্রেনীয়রা যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে পালিয়ে যাচ্ছে, তারা সমৃদ্ধ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। অবশ্যই তারা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধকবলিত বিভিন্ন এলাকা থেকে পালানোর চেষ্টা করা শরণার্থীদের মতো নয়। এমনি উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকা থেকে পালাতে চাওয়া মানুষদের মতোও নয় তারা। তারা আপনাদের পাশে বসবাসকারী যেকোনো ইউরোপীয় পরিবারের মতোই।’
পরে অবশ্য, ‘আল–জাজিরা ইংলিশ’ সংস্করণের পক্ষ থেকে ও বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়। বলা হয়, এ ধরনের বক্তব্য ‘স্পর্শকাতর ও দায়িত্বজ্ঞানহীন।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘নিজেদের সব কাজে নিরপেক্ষতা, বৈচিত্র্য ও পেশাদারত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে আল–জাজিরা ইংলিশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
ইতিমধ্যে গত শুক্রবার স্কাই নিউজে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ইউক্রেনের দিনিপরো শহরের লোকজন মলোটভ ককটেল তৈরি করছে। এর ক্ষমতা কেমন, তা ওই ভিডিওতে প্রচার করা হচ্ছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একজন এ ব্যাপারে লিখেছেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় হলো পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ইউক্রেনে মলোটভ ককটেল তৈরি করে মানুষের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার খবরকে মহিমান্বিত করে প্রচার করছে। অথচ তারা (ককটেল প্রস্তুতকারকেরা) যদি ইয়েমেন কিংবা ফিলিস্তিনের বাদামি চামড়ার মানুষ হতো, তবে তাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হতো। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল কিংবা যুক্তরাষ্ট্র সৌদি ড্রোন হামলার লক্ষ্যবস্তু বলে বিবেচিত হতো তারা।
ফ্রান্সের সংবাদভিত্তিক কেব্ল চ্যানেল বিএফএম টিভির সাংবাদিক ফিলিপ কোরবে বলেন, ‘পুতিন সমর্থিত সিরীয় সরকারের বোমা হামলা থেকে পালাতে যাওয়া সিরীয়দের নিয়ে আমরা এখানে কথা বলছি না। নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়িতে করে সরে যাওয়া ইউরোপীয়দের নিয়ে কথা বলছি আমরা।’
এদিকে দ্য টেলিগ্রাফ–এ একটি নিবন্ধ লিখে অনলাইনে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ড্যানিয়েল হান্নান। তিনি সেখানে লিখেছেন, এ যুদ্ধ কোনো অনুন্নত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে হচ্ছে না।
ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সমর্থন জানাতে গিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতিবিদেরা ‘বুদ্ধিজীবী’ ও ‘ইউরোপীয়’ এ ধরনের শব্দগুলো ব্যবহার করছেন। অথচ আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার দেশের অভিবাসীদের ব্যাপারে তাঁরা ভিন্নভাবে তা প্রকাশ করে থাকেন।
এ ব্যাপারে ক্ষোভ জানিয়ে টুইটারে একজন লিখেছেন, ‘মানুষের গায়ের চামড়া হলো পাসপোর্ট…চামড়ার রংই নাগরিকত্ব।’
ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য জঁ লুই বোরলাঁজেস একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইউক্রেনীয়দের অভিবাসন হবে ‘অত্যন্ত মানসম্পন্ন’।
উদারবাদী সংবাদমাধ্যমগুলোতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকট হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে এ মহাদেশে ১৯৯০–এর দশকে যে ভয়াবহ বসনীয় যুদ্ধ হয়েছে এবং ১৯৬০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড সংঘাত চলেছে, তা হয়তো তাঁরা ভুলে গেছেন।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা বর্জন কিংবা নিষেধাজ্ঞার দাবিতে আন্দোলন করলে তাকে ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম। আবার রাশিয়াকে যখন ক্রীড়াঙ্গন থেকে বর্জন করা হচ্ছে, তখন তাতে সমর্থন জানাচ্ছে তারা।
অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন রাশিয়াকে ক্রীড়াঙ্গন থেকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। অথচ এই মরিসনই গত মাসে ইসরায়েলি দূতাবাসের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত সিডনি সাংস্কৃতিক উৎসব অনেক দেশ বর্জন করায় তার সমালোচনা করেছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনকে ঘিরে ইউরোপে এখন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজছে। পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম যুদ্ধ শুরু হওয়া নিয়ে বিরতিহীন আওয়াজ তুলে যাওয়ার কল্যাণে অনেকেই ধরে নিয়েছেন, এই যুদ্ধপ্রস্তুতির পেছনে আছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্রাজ্যের লোভ। এমনও বলা হচ্ছে যে ইউক্রেনের মানুষের পরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এ রকম সব অভিযোগের পেছনে যারা বাতাস দিয়ে চলেছে, মার্কিন সরকারের বাইরে তারা হচ্ছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম, যার মালিকানা পুরোটাই বিশাল পুঁজির খপ্পরে। এই পুঁজির বড় এক স্বার্থ জড়িত আছে অস্ত্র ব্যবসায়। যুদ্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান যে হয় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা, সেই সত্য তো আমাদের অজানা নয়। আর তাই যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে ওঠার সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসার সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করা হলে সত্যের অপলাপ তাতে একেবারেই হয় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২৩৩
আপনার মতামত জানানঃ