আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে একমত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলো।
উল্লেখ্য, একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশের ব্যাংকে আর্থিক লেনদেন করতে সুইফট ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। তেল ও গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে রাশিয়া যে অর্থ আয় করে, সেই অর্থ আদায়ে দেশটি সুইফটের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, পুতিন সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বিদেশে নাগরিকত্ব নেয়া ঠেকাতে তথাকথিত ‘গোল্ডেন পাসপোর্টের’ বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সুইফট কী?
সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সুইফট হল আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজভাবে পরিচালনায় ব্যাংকগুলো দ্রুত এবং নিরাপদে বৈশ্বিক লেনদেন করে থাকে।
সুইফট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ২০২০ সালে প্রতিদিন প্রায় ৩৮ মিলিয়ন লেনদেন হয়েছে, যা ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের লেনদেন সুবিধা দিয়েছে।
সুইফট ১৯৭০ এর দশকে হাজার হাজার সদস্য প্রতিষ্ঠানের একটি সমবায় পরিষেবা। বেলজিয়াম ভিত্তিক এই পরিষেবা বাণিজ্য বিরোধের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকে।
ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় ন্যাশনাল ব্যাংক অব বেলজিয়াম এই পরিষেবার দেখভাল করে থাকে।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা?
বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশের ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুইফট যুক্ত। রাশিয়া তার তেল ও গ্যাস রপ্তানির জন্য সুইফট সিস্টেমের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর বাদ দেওয়ার পদক্ষেপের প্রভাব দেশটির ব্যাংকিং নেটওয়ার্কে পড়বে।
কারণ, এই ব্যবস্থার আওতায় লেনদেন করা রুশ ব্যাংকগুলো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে। ফলে দেশটির অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
হোয়াইট হাউসের ভাষ্যমতে, এই পদক্ষেপের ফলে অর্থ লেনদেনের জন্য দেশটিকে বিকল্প ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করবে।
অতীতে শুধু একটি দেশকেই সুইফট থেকে বাদ দেওয়া হয়। সে দেশটি হলো ইরান। এর ফলে ইরানকে তার বৈদেশিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ হারাতে হয়।
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইন বলেছেন, রাশিয়া যাতে তার যুদ্ধকালীন অর্থ ভাণ্ডার ব্যবহার করতে না পারে, পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো সে ব্যাপারেও কাজ করছে।
সেজন্য রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাতে কোন সম্পদ বিক্রি করতে না পারে সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেই সাথে ব্যাংকটির অন্যান্য আর্থিক লেনদেন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানিয়েছেন, তথাকথিত ‘গোল্ডেন পাসপোর্টের’ বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যাতে করে পুতিন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পদশালী রাশিয়ানরা পশ্চিমা দেশগুলোতে নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানকার আর্থিক ব্যবস্থায় প্রবেশ ও সুবিধা নেবার সুযোগ না প্রায়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এক টুইট বার্তায় বলেছেন, পুতিন যাতে তার আগ্রাসনের মূল্য দেয় সেজন্য আমরা একসাথে কাজ করবো।
এর প্রশংসা করে পাল্টা টুইট বার্তায় ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্মাল লিখেছেন, অন্ধকার দিনে এটি হবে বড় সাহায্য।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, কানাডা এসব আর্থিক বিধিনিষেধ আরোপের ব্যাপারে একমত হয়েছে। ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর এটি হবে রাশিয়ার উপর আরোপ করা সর্বশেষ অবরোধ।
সুইফট ব্যবস্থা থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে সরিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেনে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। কারণ প্রায় সব ব্যাংক এই ব্যবস্থার আওতায় লেনদেন করে।
ঝুঁকিতে কি ইউরোপও?
জার্মান সরকারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, রাশিয়ান এসব ব্যাংকে বৈদেশিক অর্থ লেনদেন বন্ধ করাই তাদের এই উদ্যোগের মুল উদ্দেশ্য।
কিন্তু রাশিয়ার সাথে ব্যবসা রয়েছে, এমন পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোও এর ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। সুইফট-এর সকল লেনদেনের দেড় শতাংশ রাশিয়া থেকে হয়ে থাকে।
রাশিয়ার নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংক বাছাই করার মাধ্যমে পশ্চিমারা মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞার সর্বোচ্চ প্রভাব ফেলতে চাইছে। অন্যদিকে, ইউরোপের ওপর প্রভাব যাতে কম পড়ে, সেই ব্যবস্থা তারা নিশ্চিত করতে চাইছে।
সুইফট থেকে রুশ ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার প্রভাব শুধু রাশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। ক্ষতির মুখে পড়বে অন্য দেশও। রাশিয়া থেকে তেল বা গ্যাস ক্রেতা দেশগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান তেল ও জ্বালানি সরবরাহকারী রাশিয়া।
রাশিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী অ্যালেক্সি কুদরিনের মতে, সুইফট থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করা হলে দেশটির অর্থনীতি ৫ শতাংশ কমতে পারে।
উল্লেখ্য, বেলজিয়াম ভিত্তিক সুইফট বিশ্বের এগারো হাজার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বিশ্বব্যাপী খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখলেও কোন দেশের উপর অবরোধ আরোপের আইনি ক্ষমতা নেই প্রতিষ্ঠানটির।
রাশিয়া কী করতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে নারাজ। এর একটি কারণ হল, এটি রাশিয়ার ব্যবসার ওপর গুরুতর প্রভাব নাও ফেলতে পারে।
রাশিয়ার একটি বড় ব্যাংক ‘ভিটিবি’র প্রধান সম্প্রতি বলেছেন, তিনি লেনদেনের জন্য অন্যান্য চ্যানেল ব্যবহার করতে পারেন। যেমন- ফোন, মেসেজিং অ্যাপ বা ইমেল।
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি এমন দেশগুলোর মাধ্যমেও রাশিয়া লেনদেন করতে পারে। যেমন, চীন সুইফটের প্রতিদ্বন্দ্বী নিজস্ব লেনদেন ব্যবস্থা তৈরি করেছে।
উল্টো সুইফটে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে এর প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের চিপস সিস্টেমের ব্যবহার বাড়বে। এটি বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে মার্কিন ডলারের স্থিতিক ক্ষতিগ্রস্তও করতে পারে এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো বিকল্পগুলোর ব্যবহার বাড়াতে পারে।
বাইডেন বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা বাড়ালেও তিনি এখনই সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দিতে চাচ্ছেন না, কারণ এতে অন্য আরও দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ