উন্নত জীবনযাত্রা, কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা, আশ্রয়— নানা কারণেই অনেকের স্বপ্নের গন্তব্য ইউরোপ। প্রতিবছর অনেক মানুষ ইইউভুক্ত ২৭টি দেশে বসবাস ও কাজের সুযোগ পান। অন্যদিকে অবৈধভাবে যাওয়া বড় একটি অংশকে ফেরতও পাঠানো হয়।
গত বছর ইউরোপের দেশগুলোতে রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি আশ্রয় আবেদন করেছেন৷ তবে যত আবেদন জমা পড়েছে তার ৯৬ শতাংশই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে৷ আশ্রয় আবেদনের স্বীকৃতির বিবেচনায় বাংলাদেশিরা রয়েছেন সর্বনিম্নের তালিকায়৷
গত বছর ‘ইইউ প্লাস’ হিসেবে পরিচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও লিশটেনস্টাইনে অভিবাসী ও শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন ২০ হাজার বাংলাদেশি। যা তার আগের বছরের তুলনায় গত বছর ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে আবেদন মঞ্জুর হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর অ্যাসাইলামের (ইইউএএ) আশ্রয় আবেদনের প্রবণতাসংক্রান্ত বার্ষিক হালনাগাদ প্রতিবেদনের বরাতে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে এসব তথ্য জানিয়েছে।
নিজ দেশে বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, রাজনৈতিক কারণে কেউ নির্যাতনের শিকার হলে বা কারও জীবন হুমকির মুখে থাকলে তিনি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ইউরোপের দেশগুলোতে সুরক্ষা চেয়ে আবেদন করতে পারেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কতসংখ্যক আবেদন জমা পড়ছে, তা নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে ইইউএএ।
সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালে ‘ইইউ প্লাস’ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও লিশটেনস্টাইনে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি। ২০১৪ সালে ইইউএএ-এর পরিসংখ্যান প্রকাশ শুরু হওয়ার পর থেকে এটি বাংলাদেশিদের আবেদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
গত বছর বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৬ লাখ ১৭ হাজার ৮০০টি আবেদন জমা পড়েছে। এই সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি। সবচেয়ে বেশি আবেদন করেছেন আফগান ও সিরীয়রা। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আবেদনকারীর তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলো। তালিকায় প্রথম পাঁচে রয়েছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান ও তুরস্ক। বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।
গত বছর ‘ইইউ প্লাস’ হিসেবে পরিচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও লিশটেনস্টাইনে অভিবাসী ও শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন ২০ হাজার বাংলাদেশি। যা তার আগের বছরের তুলনায় গত বছর ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে আবেদন মঞ্জুর হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশিদের আবেদনের হার তিন–চতুর্থাংশ বেড়েছে। তাদের মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বাংলাদেশিও আছে।
২০২১ সালে বেশির ভাগ আশ্রয় আবেদন জমা পড়েছে বছরের শেষার্ধে। প্রতি ১০টির মধ্যে ৯টিই ছিল প্রথমবারের মতো আবেদন। উল্লেখ্য, প্রথমবার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারেন আশ্রয়প্রার্থীরা।
ইইউএএ-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৭ হাজার ৩০০ আবেদনকারী তাদের ‘অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক’ হিসেবে দাবি করেছে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাদের মধ্যে অর্ধেক বা প্রায় ১৩ হাজার আবেদনকারীই আফগান নাগরিক।
‘অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক’ দাবি করা আবেদনকারীদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন সিরীয়রা। তাদের আবেদনের সংখ্যা ছিল সাড়ে চার হাজার।
এরপরই রয়েছে বাংলাদেশিরা। তাদের এমন প্রায় ১ হাজার ৪০০ আবেদন জমা পড়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। ২০২০ সালের তুলনায় এই সংখ্যা ১৭৪ শতাংশ বেশি। তবে ২০২১ সালে বাংলাদেশি মোট আবেদনকারীর হিসেবে ‘অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্কের’ সংখ্যা মাত্র ৭ শতাংশ।
২০২১ সালে বাংলাদেশিদের প্রায় ১৬ হাজার ৩০০টি আশ্রয় আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। আগের বছরের চেয়ে এই সংখ্যা দুই–তৃতীয়াংশ বেড়ে ২০১৮ সালের রেকর্ড পরিসংখ্যানের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
তবে এরপরও ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ১২ হাজার ১০০টি আবেদন ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। এগুলোর পাঁচ ভাগের তিন ভাগ আবেদন করা হয়েছিল ছয় মাসের কম সময়ের মধ্যে।
ইইউ প্লাস দেশগু দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের আবেদনের প্রবণতা যেমন বেড়েছে, তেমনি আবেদন প্রত্যাখ্যানের হারও বেড়েছে। ২০২১ সালে ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশিদের আবেদন বাতিল হয়েছে। মাত্র চার শতাংশ আবেদনকারী ‘সাবসিডিয়ারি প্রটেকশনের’ অধীন ইউরোপে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন।
২০২১ সালে সব দেশ মিলিয়ে আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন গ্রহণের গড় হার ছিল ৩৫ শতাংশ। আবেদন গৃহীত হওয়াদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ইরিত্রীয়রা। তাদের ৮১ শতাংশের আবেদন গ্রহণ হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ইয়েমেনি নাগরিকেরা। তাঁদের আবেদন গ্রহণের হার ৭৯। এ ছাড়া বেলারুশের নাগরিকদের ৭৫ শতাংশ, সিরীয়দের ৭২ শতাংশ ও আফগানদের ৬৬ শতাংশ আবেদন মঞ্জুর হয়েছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তেমন একটা দেখা যায়নি৷ আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো পরিস্থিতিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে নাই৷ তাই, ইইউতে দেশটির বাসিন্দাদের আশ্রয়ের আবেদন তেমন একটা গ্রহণ করা হয় না৷
মোটের উপর ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি বাংলাদেশ, ইরাক এবং গাম্বিয়ার নাগরিকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের সুপারিশ করেছে, যদি তারা ইউরোপে অবস্থানরত বৈধ বসবাসের অধিকার নেই এমন দেশগুলোর নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে সহায়তা না করে৷
বাংলাদেশ সরকার এরকম নিষেধাজ্ঞা এড়াতে দূতাবাসগুলোর প্রতি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সহায়তার নির্দেশনা দিয়েছে৷
যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবস্থাদৃষ্টে শান্ত রয়েছে, তাসত্ত্বেও দেশটির মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং কমিটি এগেনিস্ট টর্চারের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো মাঝে মাঝেই বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে নির্বিচারে আটক, নির্যাতন, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনে৷
গত দশকে দেশটিতে বেশ কয়েকজন ইসলাম ধর্মের সমালোচক ব্লগার ও সমকামীদের অধিকারের পক্ষে সংগ্রামরত অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যা করেছে উগ্রপন্থিরা৷ এরপর অনেক বাংলাদেশি ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন৷
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জার্মানির বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ বের্নহার্ড হার্টলাইন মনে করেন, জার্মানি থেকে অনিয়মিত অভিবাসীদের বিতাড়ন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়৷ তবে তিনি বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদনগুলো আলাদা আলাদাভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাইয়ের আহ্বান জানান৷
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে৷ কিছুদিন আগে কারাগারে একজন লেখকের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ মৃত্যুর আগে তার জামিনের আবেদন বেশ কয়েকবার বাতিল হয়েছিল৷ তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷’
হার্টলাইন, ‘এধরনের ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে দেশটিতে শুধু নাস্তিক ব্লগার বা এলজিবিটিকিউ অ্যাক্টিভিস্টরাই নয়, সরকার সমালোচক এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও হুমকি এবং নির্যাতনের মুখে রয়েছেন।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ