করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছরে যত মৃত্যু ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে পরিবেশ দুষণজনিত কারণে। মঙ্গলবার প্রকাশিত হওয়া জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এ তথ্য।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ইতোমধ্যে দূষণমুক্ত পরিবেশকে মৌলিক মানবাধিকারের অন্তর্ভূক্ত করেছে। আগামী মাসে পরিষদের সভায় এই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে। মঙ্গলবার তার খসড়া প্রকাশিত হয়েছে মানবাধিকার পরিষদের ওয়েবাসিইটে।
সেখানে বলা হয়েছে—কীটনাশক, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিক ও রাসায়নিক দুষণের কারণে গত দুই বছরে বিশ্বজুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৯০ লাখ মানুষ, অন্যদিকে একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫৯ লাখ মানুষের।
মহামারির থেকে বেশি মৃত্যু
পরিবেশ দূষণ বলতে বায়ু, পানি ও মাটি এবং কর্মক্ষেত্রে দূষিত পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। পরিবেশ দূষণ জনিত কারণে মারা যাওয়া অধিকাংশই নিম্ম বা মধ্যম-আয়ের দেশের বাসিন্দা। এইসব দেশে প্রতি চারজনে একজন পরিবেশ দূষণ জনিত রোগ আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে; বলা হয়েছে, ‘পরিবেশ দূষণ ও বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেসব যে ব্যার্থ— তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট; এবং এই ব্যার্থতার কারণেই বিশ্ববাসীর একটি পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর ও টেকসই পরিবেশ পাওয়ার অধিকারের লঙ্ঘণ ঘটেছে ব্যাপকমাত্রায়।’
প্রতিবেদনে পলিথিন, নন-স্টিক হাঁড়ি-পাতিল ও সহজে নষ্ট না হওয়া রাসায়নিক দ্রব্য বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ ঘোষনার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে— এসব উপাদান মানবদেহে ক্যান্সারের পরিবেশ তৈরি করে।
প্রতিবেদনে বিশ্বের দুষণযুক্ত এলাকাগুলোতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে; আর যেসব এলাকার অবস্থা খুবই গুরুতর— সেসব এলাকার দরিদ্র, প্রান্তিক ও আদিবাসী লোকজনকে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরের সুপারিশও করা হয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, যেসব এলাকায় পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে— বর্তমান বিশ্বে সেসব এলাকা সবচেয়ে দুষিত অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান দূত মিশেলে ব্যাশেলেট ইতোমধ্যে পরিবেশ দূষণকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি বলে উল্লেখ করেছেন।
পরিবেশ দূষণের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। দূষণ জনিত মৃত্যুতে সবচেয় বড় ভূমিকা বায়ু দূষণের, যা মোট মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। প্রতি বছর বায়ু দূষণের কারণে ৬৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
আইকন স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক ফিলিপ ল্যান্ডরিগান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়ে পরিবেশ দূষণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা নানা দিক দিয়ে মানবজাতির স্বাস্থ্য ও সুস্থতার উপর একটি গভীর ও বিস্তৃত হুমকি।
বায়ু দূষণের পরই পানি দূষণের অবস্থান। প্রতি বছর প্রায় ১৮ লাখ মানুষ পানি দূষণ জনিত রোগে ভুগে মারা যান। কর্মক্ষেত্রে দূষণ ৮ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশে পানি দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ আর্সেনিক। দেশটির প্রায় পাঁচ কোটি ৭০ লাখ মানুষ যে পানি ব্যবহার করে সেখানে আর্সেনিকের মাত্রা প্রতি লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রাম। যেখানে ডব্লিউএইচও নির্ধারিত সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটার ১০ মাইক্রোগ্রাম।
লানসেটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশ দূষণ জনিত কারণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৯২ শতাংশই দরিদ্র দেশগুলোর বাসিন্দা।
তবে ভারত ও চীনের মত দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এ ধরণের মৃত্যুর হার বাড়ছে। দূষণ জনিত কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হওয়া দেশগুলোর তালিকায় ভারতের অবস্থান পঞ্চম, চীন আছে ষোড়শ স্থানে।
যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর দূষণ জনিত কারণে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, তালিকায় ৫৫তম স্থানে দেশটি। ১৮৮ দেশের উপর দুই বছর ধরে গবেষণার পর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ ৫৫ হাজার মানুষ দূষণ জনিত কারণে মারা যায়।
বিশ্বে প্রতি ছয়টি মৃত্যুর মধ্যে একটির জন্য দায়ী দূষণ। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ। দেশে দূষণের কারণে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। বায়ু, পানি ও মাটির দূষণে এসব মৃত্যু ঘটছে।
বিশ্বে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি দশকের পর দশক ধরে সরকারের কর্মকাণ্ড ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় অবহেলিত থেকে গেছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। যদিও বর্তমানে রোগ ও মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দূষণ।
বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পৃথিবী
পৃথিবী এখনও প্রায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের দিক থেকে প্রথম সারির দেশ গুলোর একটি। প্রতি বছর প্রায় গড়ে ২২ বিলিয়ন টন কার্বনডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০-১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।
আমি, আপনি, অন্য দশজন ঠিক যেভাবে বিষয়টিকে নিতে পারবো, হলফ করে বলতে পারি বিষয়টি তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়াবহ। একটি জাতি নয়, একটি দেশ নয়, একটি মহাদেশও নয়- পুরো দুনিয়াটাই জড়িত হয়ে আছে বিষয়টিতে।
বিলিয়ন মানুষের বসবাসের বড় অংশ যদি চলে যায় সমুদ্রেগর্ভে, তাহলে জেগে থাকা অল্প জায়গা জুড়ে এত মানুষের ভর কেমন করে সইবে সেই সময়ের ছোট্ট ধরণী? এটুকুতেও শান্ত হবে না প্রকৃতি। বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে জেগে থাকা অংশটিও।
ভয়াবহ গরমে টিকতে পারাটা সহ্যসীমার বাইরে চলে যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা সেই ১৯৯৮ থেকে এই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিষয়টি উপলব্ধি করেছে, সতর্ক করতে চেয়েছে বিশ্ববাসীকে বারবার। কিন্তু তাদের বাণীর স্রোত ছিল ধীরগতি। যথাযথভাবে তা পৌঁছেনি মানব সমাজের কাছে। হালকা করে দেখেছে সবাই।
কিন্তু যখন আজ এসে দেখছে, ১৯৯৮ সাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত দ্বিগুণ হয়েছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, তখন হয়তো ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছে কেউ কেউ। এই সেদিন ২০১৭-এর মে মাসে অ্যান্টার্কটিকার ১১ মাইল ব্যাপি একটি বরফখন্ড মাত্র ৬ দিনে ভেঙ্গে গেল, গলে গেল; ঠিক তখনই কোনো কোনো বিজ্ঞানীর চোখে বড় বড় চিন্তার রেখা দেখা দিয়ে গেল।
হয়তো আরও কয়েক মাইল জুড়ে বরফখন্ড গলে গিয়ে সমুদ্রের পানির সঙ্গে মিশে জলবায়ু সংকটের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। একদিকে বরফ গলে সমুদ্রের জলসীমা বৃদ্ধি করছে, অন্যদিকে বরফ গলে যাওয়ায় ঠান্ডা প্রকৃতি তপ্ত প্রকৃতির বুকে চলে যাচ্ছে। একদিকে বরফ গলে সমুদ্রের জলরাশি বাড়াচ্ছে এবং নতুন নতুন ভূমি দখল করে নিচ্ছে, অন্যদিকে বরফের কমতি হওয়ায় আবহাওয়া গরম হয়ে যাচ্ছে।
তৃতীয় সমস্যা শুরু হবে যখন সমুদ্র নতুন নতুন জনপদ দখল করে নেবে এবং আক্রান্ত জনপদ আশ্রয়ের স্বার্থে সমুদ্রে জেগে থাকা স্বল্প ভূমিতে স্থানান্তরিত হতে ছুটবে। অল্প পরিসরে বেশি মানুষের বাস- নানা সমস্যার সঙ্গে তপ্ত আবহাওয়াও উপহার দিতে ভুল করবে না তখন প্রকৃতি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ জেমস হানসেন এই ভবিষ্যৎ ভয়াবহতাকে নামকরণ করেছেন ‘সাইন্টিকি রেটিসেন্স’। তিনি ২০১৬ সালেই বলেছেন, ‘জলবায়ুর এই ভয়াবহতা কোনো সাধারণ ভয়ের বিষয় নয়, এটি নীরবে খেতে আসছে বিশ্ব জনপদকে।’
জাতিসংঘের অধীনে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে মারাত্মক কিছু রিপোর্টিং হয়েছে ইতোমধ্যেই। সম্প্রতি একটি রিপোর্ট এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে যে, আমরা পৃথিবীর মানুষ আজ যেভাবে আছি সেভাবেই যদি চলতে চাই তাহলে আগামী একশ বছরে উষ্ণতা ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি হতে পারে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে আজকের দিনে পৃথিবীর যেখানে যখন যে তাপমাত্রা বিরাজ করছে, এক শ’ বছর পর সেখানে যোগ হবে আরো ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কেউ কেউ তো এই উষ্ণতা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে। আমরা ডাইনোসরের কথা জানি। ইতিহাস বলে, ২ শ ৫২ মিলিয়ন বছর পৃথিবী নামক গ্রহে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর ফলে পৃথিবীর ৯৭ ভাগ জীবন মৃত্যুবরণ করেছিল। বর্তমানে আমরা অধিক দ্রুত হারে কার্বন নিঃস্বরণ করছি। কারো কারো ধারণা, বর্তমান সময়ে শতকরা ১০ ভাগ অধিক হারে নিঃস্বরিত হচ্ছে কার্বন।
তাইতো ষ্টিফেন হকিং, এল্টন মাস্কের মতো বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহসহ অন্যান্য গ্রহে আগামী ৪০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে বিকল্প বসবাসের জায়গা খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ