বিশ্ববাসীর চোখ এখন ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে। সেখানে ইউক্রেনকে ঘিরে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। যেকোনো সময় পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক এ দুই পরাশক্তি যুদ্ধে জড়াতে পারে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও হুঁশিয়ারিতে কাটছে একেকটি দিন। উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তবে কি ২০২২ সালে আরেকটি বড় যুদ্ধ দেখবে বিশ্ববাসী? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব। পশ্চিমাদের দাবি, রাশিয়া যেকোনো সময় ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে। এ সংঘাত ঠেকাতে এরই মধ্যে পূর্ব ইউরোপে সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে ন্যাটো সদস্যরা। ইউক্রেন সীমান্তে আনাগোনা বেড়েছে রুশ সেনাদের। অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণত মানুষও। ফলে গোটা বিশ্বের নজর এখন সাবেক সোভিয়েত দেশটিতে।
ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় এক লাখ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া। যেকোনো মুহূর্তে রুশ সেনারা দেশটিতে আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, আগামী বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনে হানা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। তবে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ এ ধরনের কথাবার্তাকে মার্কিন ‘প্রোপাগান্ডা’ বলে অভিহিত করেছে।
জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকা গত শনিবার ইউক্রেনে সম্ভাব্য রুশ হামলার দিনক্ষণ–সম্পর্কিত খবরটি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ও সামরিক সূত্র উভয়ই ন্যাটো জোটের সদস্যদের ইউক্রেনে সম্ভাব্য রুশ হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছে। এই জরুরি সতর্কতায় বলা হয়, বুধবার ভোরের দিকে ইউক্রেনে হামলা শুরু করতে পারে রাশিয়া।
পশ্চিমাদের ভাষ্যমতে, মস্কো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেন সীমান্তে এক লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করেছে। সীমান্তে এই রুশ সেনা মোতায়েনের উদ্দেশ্য হলো ইউক্রেনে হামলা চালানো।
তবে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা অস্বীকার করে আসছে রাশিয়া। মস্কো বলছে, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো জোটের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতির জন্য তারা হুমকি বোধ করছে।
ইউক্রেন সংকট নিষ্পত্তির জন্য জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি উভয় পক্ষ সামরিক প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
ইউক্রেন নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য একে অপরকে দায়ী করলেও দুই দেশই নিজেদের মধ্যে কোনো সংঘাত চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেছেন, ক্রিমিয়া ইস্যুতে নিজের নাগরিকদের উদ্ধারেও সেনা পাঠাতে চায় না দেশটি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যদি একে অপরকে গুলি করতে শুরু করে তবে তা হবে বিশ্বযুদ্ধ।
আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও গবেষকরা আগে থেকেই বোঝার চেষ্টা করে আসছেন, ঠিক কী হবে যদি দুই দেশ পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
২০১৯ সালে ইনডিপেনডেন্ট ইউকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা সায়েন্স অ্যান্ড গ্লোবাল সিকিউরিট প্রোগ্রামের (এসজিএস) আওতায় এক গবেষণায় সিম্যুলেশন কাজে লাগিয়ে দেখতে পেয়েছেন, ন্যাটো ও রাশিয়ার সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধে প্রথম ঘণ্টায়ই প্রাণ হারাবে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এবং আহত হবে প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখ। তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণে অসুস্থ হওয়া কিংবা মৃত্যুবরণ করা, দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাবের কারণে মারা যাওয়াকে এর মধ্যে বিবেচনা করা হয়নি।
ন্যাটো ও রাশিয়ার সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধে প্রথম ঘণ্টায়ই প্রাণ হারাবে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এবং আহত হবে প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখ।
এসজিএস দাবি করেছে, তাদের গবেষণা বাস্তব নিউক্লিয় সক্ষমতা, লক্ষ্য ও মৃত্যুর অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে। তাদের বানানো সিম্যুলেশনের ভিডিওতে দেখা যায়, প্রথম পারমাণবিক বোমাটি পোল্যান্ডের ভেতরে রকলা নামক শহরে বিস্ফোরণ ঘটায়। যে শহরটি চেক প্রজাতন্ত্র ও জার্মানির সীমান্তের কাছে অবস্থিত।
ইনডিপেনডেন্ট ইউকের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এই মডেলে এমন কোনো পরিস্থিতি আছে কি না, যেখানে ন্যাটো প্রথম পারমাণবিক হামলার সূত্রপাত করবে।
এজিএস প্রোগ্রামের একজন পদার্থবিজ্ঞানী জিয়া মিয়ান জানিয়েছেন, এই সিম্যুলেশনটি প্রচলিত ন্যাটো-রাশিয়া যুদ্ধের ভিত্তিতে তৈরি। যেখানে রাশিয়া তার পারমাণবিক নীতি অনুসারে আগে হামলা শুরু করেছে।
এই গবেষণার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ ও যুক্তরাজ্যে রাশিয়ার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল।
তবে রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক স্যাম ডুডিন, সিম্যুলেশনের ফলাফলের বিষয়ে একমত হতে পারেননি। তিনি বলেন, এ ধরনের পারমাণবিক যুদ্ধ আসলে হতেই পারে না। কারণ ১৯৫০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিই হলো রাশিয়ার সঙ্গে প্রচলিত যুদ্ধ এড়িয়ে চলা। মস্কোও ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধ চায় না।
ডুডিন আরও বলেন, যদি অপারেশনাল দিক থেকে বিচার করা হয়, তাও সিম্যুলেশন দেখে মনে হচ্ছে, ইউরোপ থেকে সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে। বিমান থেকে শুরু করা পারমাণবিক হামলার ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলতে পারে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
এ ছাড়া সিম্যুলেশনে হতাহতের হিসাবও কম বলে মনে হয়েছে ডুডিনের কাছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ