শাম্মী হক
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে মুসকান নামের মেয়েটির প্রতিবাদী প্রতিরোধ দেখেছি। ওতগুলো আক্রমণাত্মক ছেলেদের সামনে আত্মবিশ্বাসের সাথে, মেরুদণ্ড টানটান করে মেয়েটির হেঁটে চলে যাওয়া দেখে ভালো লেগেছে, তাকে স্যালুট।
কিন্তু এই “আল্লাহু আকবর“ কিংবা “জয় শ্রীরাম“ এবং কর্ণাটক রাজ্যে গত কয়েক সপ্তাহে হিজাব পরার অধিকারের আন্দোলন- সবটাই রাজনৈতিক।
একটি প্রতিষ্ঠানে ড্রেস কোড থাকলে সেটা শিক্ষার্থিরা মেনে না চললে, তার বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেয়াটা স্বাভাবিক এবং জরুরি, কিন্তু সেটাও হতে হবে গণতান্ত্রিকভাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেকোন ধর্মীয় প্রতীকের বিরোধী। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত জায়গাগুলোতে মুখমণ্ডল দৃশ্যমান থাকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, যদিও করোনার মত মহামারিতে স্বাস্থ্যের বিবেচনায় বাধ্যতামূলক ফেইস মাস্ক পরা ব্যাতিক্রম এবং অস্থায়ী।
- তবে ‘হিজাব ইজ মাই চয়েস’ এর বিরোধী আমি। ইসলামে নারীর পর্দা প্রথা এসেছে নারীকে „সুরক্ষার“ নামে বস্তায় বন্দি করতে, নারীকে দেখা হয় ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে। বোরকা কিংবা হিজাব ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক এবং নারী বিদ্বেষী, রাজনৈতিক ইসলামের এক শক্তিশালী পতাকা।
- কিন্তু নারীবাদের নামে কিংবা মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ রাষ্ট্রে ‘ডাইভারসিটি’ কিংবা ‘বৈচিত্র্য’র নামে এই ইসলামিষ্ট প্রতীককে প্রমোট করা শুধুমাত্র ভুলই না, লক্ষ লক্ষ নারীর মুখে চপেটাঘাত স্বরূপ, যে নারীরা বর্তমানে পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, জেল খাটছে।
- বুকে এবং মাথায় ওড়না না থাকার কারণে আমি বাংলাদেশের রাস্তায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ‘খানকি’ ‘বেশ্যা’ ‘খারাপ মেয়ে’- প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে, ওড়না না পরার কারণে। আমার মাকে বিভিন্নসময় অপমান অপদস্থ করা হয়েছে এবং এখনো হয়, তার মেয়ে „ঠিকমত“ পোশাক না পরার কারণে। এই ধর্মবিশ্বাসীরা যারা এখন ব্যক্তিস্বাধীনতার, পোশাকের স্বাধীনতার কথা বলছে, তারা আমার পোশাককে আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা বলেনি, এখনো বলে না এবং কোনদিন বলবেও না।
- ইরানের বাধ্যতামূলক পর্দার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে “দুর্নীতি ও পতিতাবৃত্তিতে উসকানি দেওয়ার” অভিযোগে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড শাস্তি। বর্তমানে ডজনখানেক নারীরা ইরানের জেলে আছে কারণ তারা পাবলিক জায়গায় হিজাব পরেনি। গতবছর বাইশ বছরের তরুণী সাবা আফসারি জনসমক্ষে হিজাব না পরে, হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে! মরিয়ম নামের এক আফগান নারীকে গত বছরের জুলাই মাসে জার্মানির বার্লিনে তার দুই ভাই নির্মম ভাবে খুন করেছে ‘অনার কিলিং’ এর নামে, কারণ মরিয়ম স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছে, শরীর, চুল ঢাকতে চায়নি। এই মুসলিম ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসীরা মরিয়ম কিংবা আফসারিদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী না!
আর একদল উদারপন্থী ‘ইসলামফোবিয়া’ কিংবা ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ ট্যাগ দিয়ে এক ভয়াবহ সেন্সরশিপ তৈরি করছে পশ্চিমা দেশগুলোতে। ইসলাম এবং শরিয়া নিয়ে ইসলামি কিংবা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সমালোচনা করলে জেলজুলুম, খুন এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। আর পশ্চিমা দেশে তারা হয় ইসলামফোবিক।
হ্যাঁ, মুসলিমরা অমুসলিম দেশে বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, ভারতে যেমন হচ্ছে, তেমনি এই জার্মানিতেও। কিন্তু তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে হিজাবের মত নারী বিদ্বেষী, রাজনৈতিক প্রতীককে প্রমোট করা অনৈতিক। তারপরও প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা নিজের ইচ্ছেয় হিজাব/স্কার্ফ পরতে চাইলে, যেমনটা আমার মা, খালা এবং অনেক কাছের বান্ধবীরা পরেন, তার বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নেই।
ইসলামে নারীর পর্দার বিধানে নারীর স্বাধীনতা নেই, সেখানে নারীরা শুধু পরতেই বাধ্য, খুলে ফেলার স্বাধীনতা তাদের নেই। তাই হিজাব কোনদিন নারীর চয়েস হতে পারে না, কারণ এটা কোনদিন তাদের চয়েসই ছিল না। তাই মুসকানের সাহসকে সাধুবাদ জানাচ্ছি তার বোল্ডনেস এর কারণে তার বোরকার কারণে নয়।
আপনার মতামত জানানঃ