করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন-যাপন অনেকটাই কোণঠাসায় আটকে পড়েছে। দৈনন্দিন পরিকল্পনায় মানুষ আগের মতো স্বাভাবিকতা রাখতে পারছে না। দেশের অধিকাংশেরই আয় কমে গেছে, জীবন মানও নেমে গেছে অনেক। সংকটের ভেড়াজালে মানুষের কোনো রকম বেঁচে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরইমধ্যে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাড়ছে দ্রব্যের মূল্য।
উৎপাদন বেড়েছে, দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করার পর উদ্বৃত্ত থাকছে চাল নিয়ে এমন বক্তব্য সচরাচরই শোনা যায়; কিন্তু সরকার তথা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপ সত্ত্বেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে চালের দাম, যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে দিশেহারা করে তুলছে।
সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত ২০ লাখ টনের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই সরকারিভাবে এত খাদ্যশস্য মজুত ছিল না, কিন্তু বিস্ময়কর হলো তারপরও চালের দাম কমছে না; উল্টো বাড়ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে বুধবার রাজধানীর বাজারগুলোতে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর সরু চাল (মিনিকেট-নাজিরশাইল) বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা কেজি দরে। এক বছরে বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বুধবার দেশে মোট খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ছিল ২০ লাখ ২ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুত হচ্ছে ১৬ লাখ ৯৪ হাজার টন। গম ২ লাখ ৭৭ হাজার; আর ধান ৪৯ হাজার টন।
অতীতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সরকারিভাবে চালের এত মজুত আগে কখনই ছিল না। গত বছর এই সময়ে সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২১ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুত ছিল ৫ লাখ ৩৭ হাজার টন, যা মজুত হিসেবে ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে কম।
আমনের ভালো ফলন আর সবশেষ বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনের রেকর্ড হলেও বুধবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো চালের দাম কেজিতে অন্তত দুই টাকা করে বেড়েছে।
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি মুদি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৮ থেকে ৭০ টাকা; যা এক মাস আগেও ছিল ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে মোজাম্মেল রাইস এজেন্সির আড়ত রয়েছে। এখান থেকে ঢাকা শহরে পাইকারি দামে চাল সরবরাহ করা হয়।
এই আড়তের কর্ণধার মতিউর রহমান তরু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক মাস ধরে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের বাজার বাড়তি। গত এক সপ্তাহেও এ দুটো চালের ৫০ কেজির বস্তা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।’
তিনি জানান, নতুন মৌসুমের নাজিরশাইল চাল প্রতি কেজি ৫৮ টাকা এবং পুরান মৌসুমের চাল ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে দাম বেড়েছে ২ টাকা করে।
রেকর্ড মজুতের পরও কেন বাজারে চালের দাম না কমে উল্টো বাড়ছে, এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও ব্যবসায়ীরা।
চলতি আমন মৌসুমে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৩ লাখ টন আমন ধান এবং ৫ লাখ টন সিদ্ধ আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। এর মধ্যে গত জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।
সোমবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবৈধ মজুতদারি রোধে করণীয় ও বাজার তদারকিসংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার রেকর্ড পরিমাণ মজুতের পরও চালের চড়া দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘গতবার আম্পানে ধান নষ্ট হয়েছে। ভালো সংগ্রহ হয়নি। সর্বনিম্ন মজুত ছিল চার লাখ মেট্রিক টন। সেই সময়ও চালের দাম বাড়তে দিইনি। এবার বোরোতে যেমন বাম্পার ফলন হয়েছে, আমনেও বাম্পার ফলন। জাতীয় মজুত সর্বকালের সেরা, ২০ লাখ টনের বেশি। এখন চালের দাম বাড়ছে। এটা হাস্যকর। এখন চালের দাম বাড়াটা ভালো ঠেকছে না। হয়তোবা এই তিন বছর পরে আপনাদের কাছে আমার নতুন করে শিক্ষা নিতে হবে। আমার এই তিন বছর বরবাদ গেল। আমার সারাজীবনের রাজনীতিই বরবাদ।
দীর্ঘ দিন ধরে অভিযোগ আছে, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারি নীতি মূলত ব্যবসায়ীদের পক্ষেই চলে যাচ্ছে। এতে করে নিত্যপণ্যের দর নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণের অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয়, এবার তা প্রমাণ হলো খোদ মন্ত্রীর কথাতেই।
বাজারে মিনিকেট-নাজিরশাইল নামে যেসব চাল বিক্রি হয় সেগুলো প্রতি কেজি ৬৮-৭৫ টাকা। কাটারিভোগ, চিনিগুড়া, কালোজিরা প্রতি কেজির দাম শতাধিক। চালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। একমাত্র সবজির বাজারে কিছুটা স্বস্তি মেলে। চালের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতাসহ ১৫টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অজুহাত দিচ্ছেন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিসহ পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ও চাঁদাবাজির।
পশুখাদ্য, বেকারি আইটেম এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য চালের বাড়তি ব্যবহার হচ্ছে। তবে গত বোরো মৌসুমে এবং বর্তমানে আমনের ফলন আশাব্যঞ্জক হলেও মূলত ব্যবসায়ী, মিল মালিক, আড়তদার ও আমদানিকারকদের কারসাজিতে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই।
এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন-২০২১’-এ জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের পাঁচ কোটি ২০ লাখ মানুষ মাঝারি ও তীব্র খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে। সংখ্যাটি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ বেড়েছে। এ সময় নতুন করে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১২ লাখ।
এফএওর প্রতিবেদনে ২০২১ সালের পরিস্থিতি উঠে আসেনি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে এ বছর গম, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, মাংস, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। আগে থেকেই বেশ চড়া চালের দাম। ফলে মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে। সরকারের তুলনামূলক কম দামে চাল, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল ও চিনি বিক্রির দোকানে মানুষের দীর্ঘ লাইনই এর প্রমাণ দেয়।
এফএওর প্রতিবেদনে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা ও জনসংখ্যার হার উল্লেখ করা হয়। দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে ঝুঁকি থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জনসংখ্যার হার বিচারে ২০১৮ থেকে ২০২০ সময়ে খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে ছিল ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ, যা ২০১৭ থেকে ২০১৯ সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি।
ফসলের মৌসুমেও পণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধিতে বিস্মিত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে বাজারে দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। আর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার পেছনে সরকারের ব্যর্থতাকে মোটা অক্ষরে দায়ি করছেন তারা। এছাড়াও পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা অনুযায়ী আমদানিতে ব্যর্থতাকেও দায়ী করেছেন।
দীর্ঘ দিন ধরে অভিযোগ আছে, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারি নীতি মূলত ব্যবসায়ীদের পক্ষেই চলে যাচ্ছে। এতে করে নিত্যপণ্যের দর নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণের অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয়, এবার তা প্রমাণ হলো খোদ মন্ত্রীর কথাতেই।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যারা নীতিনির্ধারক তাদের সঙ্গে এদের কোথাও না কোথাও সম্পর্ক আছে৷ সেটা লেনদেনের সম্পর্ক৷ তা না হলে এটা হতে পারে না৷ কেউ তো নির্মোহভাবে তাদের কন্ট্রোল করছে না৷ আপনি যদি তার কাছ থেকে সুবিধা পান, তাহলে কিভাবে নির্মোহভাবে কাজ করবেন?
তারা মনে করেন, মাঠ পর্যায়ে অনেকেই আছে, তারা সঠিকভাবে কাজটা করতে চায়৷ কিন্তু উপর থেকে যখন নির্দেশ আসে তখন তাদের কিছু করার থাকে না৷ শুধু এই সরকার না, আগের সব সরকারের আমলেই এটা হয়েছে৷
তারা মনে করেন, শুধুমাত্র চাল, আলু আর পেঁয়াজ নয়, আরো আনেক কিছুতেই সিন্ডিকেট রয়েছে৷ ভোজ্যতেলেও তো সিন্ডিকেট কাজ করে৷ এই সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী এবং এদের হাত অনেক লম্বা৷ শুধু এই সরকার নয়, আগের সরকারগুলোর সময়ও আমরা দেখেছি, সিন্ডিকেটের কারণে মাঝে মধ্যেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়৷ সরকার চাইলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিত্যপণ্যের বাজরদর নিয়ন্ত্রণে সর্বপ্রথম দরকার অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেট শনাক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। এ ক্ষেত্রে দোষীদের কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। একই সাথে যেসব কৃষিপণ্যের ঘাটতি রয়েছে, সেগুলোর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমাতে বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে। কৃষিমূল্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে সারা বছর বাজারে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ ও তদারকি করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৬
আপনার মতামত জানানঃ