জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর কোথায় নেই? পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ছাপিয়ে পরিবেশ দূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তন চলে গেছে পৃথিবীর দুই মেরু অ্যান্টার্কটিকা আর আর্কটিকে। পৃথিবীর উত্তরের মেরু অঞ্চল আর্কটিকের তাপমাত্রা বাড়ছে, গলছে বরফ।
চারদিকে বরফ গলে যাওয়ার নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যা দেখে চিন্তিত পরিবেশবিদরা। বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, যেভাবে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলছে, তাতে অচিরেই নাকি ডুবে যাবে যুক্তরাষ্ট্র!
২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল সময়ে গ্রিনল্যান্ডে ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন টন বরফ গলেছে। বলা হচ্ছে, এই পরিমাণ বরফগলা পানি গোটা নিউ ইয়র্ক শহরকে ১৪ হাজার ৭০০ ফুট তলায় ডুবিয়ে দেবে!
গ্রিনল্যান্ডের বরফ নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। ড্যানিশ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করতে থাকা পোলার পোর্টাল জানিয়েছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪৭ বিলিয়ন টন গলেছে গ্রিনল্যান্ডের। এর মানে ৪৭০০ কিউবিক কিলোমিটার পানি।
এই পানি গোটা আমেরিকাকে দুই ফুট নিচে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অথবা পৃথিবীর সমুদ্রগুলোতে ১ দশমিক ২ সেন্টিমিটার বেড়ে যেতে পারে পানিস্তর।
এদিকে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলে এত বেশি পরিমাণ পানি হতে পারে যে তা, গোটা পৃথিবীর সমুদ্রের পানির স্তর ৭ মিটার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। যদি অ্যান্টার্কটিকায় বরফ গলে যায় তাহলে, সেটি ৭৫০ মিটারে গিয়ে দাঁড়াবে।
গত বছর আগস্ট মাসে আর্কটিকের বিশাল একটি হিমশৈল গলে গেছে। এ সময়ে আর্কটিক অঞ্চলের বরফে ঢাকা গ্রিনল্যান্ড থেকে সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি বরফ গলে সমুদ্রে মিশে গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলে এতো পরিমাণ পানি সাগরে মিশেছে যে, এই পানি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার পুরোটাই ঢেকে ফেলা যাবে।
১৯৫০ সাল থেকে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো একদিনে এত বেশি বরফ হারিয়েছে গ্রিনল্যান্ড। আগের রেকর্ডও এই দশকেরই। এর আগে ২০১২ আর ২০১৯ সালে এত বেশি বরফ গলে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই দ্বীপ থেকে।
আর্কটিক অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ায় হয়েছে এ বিপর্যয়। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের আরও বেশি বরফ গলবে বলেও আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
বেলজিয়ামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানান, গত বছর ওই সময় ২ হাজার ২০০ টন বরফ গলে পানি হয়ে সমুদ্রে মিশে যায়। এরমধ্যে ১ হাজার ২০০ টন বরফ গলে পানি হয়ে সমুদ্রে মিশে যায়। বাকি ১ হাজার টন বরফ অন্য হিমশৈলের সাথে মিশে আবারও বরফে পরিণত হয়।
ড্যানিশ আর্কটিক গবেষণা সংস্থা পোলার পোর্টালের একদল গবেষক এই বরফ গলার বিষয়টিকে ‘ম্যাসিভ মেল্টিং ইভেন্ট’ বলে উল্লেখ করে। তবে ২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ড থেকে যে পরিমাণ বরফ গলেছিল, তার থেকে এই পরিমাণ কিছুটা কম।
কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক জানান, যেহেতু উষ্ণায়নের কারণে গ্রিনল্যান্ড আর আর্কটিক অঞ্চলের উপরিভাগের বরফ গলে যাচ্ছে, বের হয়ে আসছে অন্ধকারে থাকা বরফের স্তর। এই বরফের ঘনত্ব বেশি থাকায় এ স্তর সূর্যের আলো ধরে রেখে পৃথিবীকে আরও উষ্ণ করছে।
মূলত উপরের বরফের স্তর সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে মহাকাশে পাঠিয়ে দেয়। এর ফলে সময়ের সাথে আরও বেশি হিমশৈল গলে যেতে পারে গ্রিনল্যান্ডের।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, গেল কয়েক দশকে সারাবিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত ২৫ শতাংশ বেড়েছে শুধু গ্রিনল্যান্ড আর পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর বরফ অঞ্চল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের হিমশৈল গলে।
আশঙ্কার বিষয় হলো, পৃথিবীর অন্য যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় আর্কটিক অঞ্চলের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। হিমশৈল মিশে আর্কটিক সাগরের পানির উচ্চতা বাড়াচ্ছে।
অথচ এ অঞ্চল বছরের অর্ধেক সময় বরফের অঞ্চল হয়ে থাকার কথা ছিল। বরফ গলায় অন্ধকারে থাকা বরফ বেরিয়ে আসছে, ধরে রাখছে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি।
গত বছর গ্রিনল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা ছিলো ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা উদ্বেগজনক। সাধারণত যে বরফ গলে, তার চেয়ে দ্বিগুণ বরফ গলছে। গ্রিনল্যান্ডে মূলত জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বরফ গলে। কিন্তু ওই বছরে মাত্র ২ মাসে ১১ হাজার টন বরফ গলে সমুদ্রে মিশেছে।
এই অঞ্চলের আয়তন ১৭ লাখ স্কয়ার কিলোমিটার, যার প্রায় পুরোটাই শ্বেতশুভ্র বরফে ঢাকা। এ দ্বীপের মোট বাসিন্দা ৫৭ হাজার। গ্রিনল্যান্ড আর অ্যান্টার্কটিকায় পৃথিবীর বিশুদ্ধ পানির ৯৯ শতাংশ মজুদ আছে। ১৯৯৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই দুই অঞ্চল ৭ ট্রিলিয়ন টন বরফ হারিয়েছে।
গ্রিনল্যান্ড উত্তর আটলান্টিক ও আর্কটিক মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত একটি সর্ববৃহৎ দ্বীপ যা ডেনমার্কের একটি স্ব-নিয়ন্ত্রিত অংশ হিসেবে স্বীকৃত। দ্বীপটির অধিকাংশই আর্কটিক বৃত্তের উত্তর অংশে অবস্থিত। এটি পশ্চিম দিকে ডেভিস প্রণালী ও ব্যাফিন উপসাগর দ্বারা প্রাথমিকভাবে কানাডীয় আর্কটিক দ্বীপপুঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং পূর্ব দিকে ডেনমার্ক প্রণালী দ্বারা আইসল্যান্ড থেকে আলাদা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১০
আপনার মতামত জানানঃ