দুই সমকামী যুবকের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ইরানে। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মারাঘে কারাগারে দুই বন্দীকে এ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটস মনিটরের বরাতে এ খবর প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল।
খবরে বলা হয়েছে, সমকামিতায় অভিযুক্ত ওই দুই যুবক গত ৬ বছর ধরে কারাগারটিতে বন্দী ছিলেন। গত রবিবার মেহেরদাদ করিমপউ এবং ফরিদ মোহাম্মদি নামে ওই দুই যুবকের ফাঁসি কার্যকর হয়।
সমকামিতার অভিযোগে ছয় বছর আগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম মাসেই ইরানে ৪৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এ সংখ্যা গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় ৩১ জন বেশি।
ইরানে সমকামিতা আইনত নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। লেসবিয়ান, গে, উভকামী ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য কঠোর দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ইরানকে।
রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ৩১০ মাইল দূরে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মারাগেহের একটি কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয় তাদের।
গত জুলাই মাসে মারাগেহের কারাগারে একই অভিযোগে আরও দুইজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে জানায় মানবাধিকার সংগঠনটি। গত বছর ইরানে ২৯৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তাছাড়া ২০২১ সালে ইরান ৮৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
ইরানে নিযুক্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক স্বাধীন তদন্তকারী কর্মকর্তা জাভেদ রেহমান জানান, ইরানে আশঙ্কাজনকভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে।
যৌনতা, ধর্ষণ, ব্যভিচার, সশস্ত্র ডাকাতি ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ইরানে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২০ সালে ২৪৬টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সময়কালে ইরানে অন্তত ৭৩ জন অপ্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
কথিত অপরাধীদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই ধর্ষণ, খুন ও মাদক সম্পর্কিত অপরাধের অভিযোগ থাকলেও অ্যামনেস্টির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের মধ্য দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়।
অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ইরান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১৫ সালের শুরুতেই অন্তত ৭০০ নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে দেশটিতে।
ইরানে সমকামিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং যৌন সংখ্যালঘুদের তাদের পরিচয় গোপনে বাধ্য করা হয়। একই লিঙ্গের মানুষের মধ্যকার শারীরিক সম্পর্কের শাস্তিতে জেল খাটতে হয়, শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখিও হতে হয়। দু’জন পুরুষ বা মহিলার মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক ইসলামে অনুমতি দেয়া হয় না।
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের মাত্র দুই মাস পর ৩০ মার্চ দেশটিতে এক ঐতিহাসিক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়৷ ওই গণভোটের মাধ্যমে ইরানের জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেন৷ সেই সময় ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়েছিল৷ এরপর ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷
লিঙ্গ বৈষম্য ইরানে নিষিদ্ধ নয়। সংবিধান অনুযায়ী সমকামিতা এখনও অপরাধ। ইরানের সমকামীরা দেশটির সমকামী ও হিজড়াদের মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে অস্পষ্টতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচারিত হচ্ছে। পিতামাতারা সমকামী সন্তানদের লিঙ্গ পরিবর্তনে বাধ্য করছেন। সেখানকার চিকিৎসকরাও সমকামীদের থেরাপি দিয়ে থাকেন। মোট কথা ইরানে সমকামিতাকে অসুস্থতা হিসেবে মনে করা হয় আজও।
আধুনিক যুগেও ইরানে নারী ও কন্যাশিশুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর নারীবিদ্বেষী আচরণে জর্জরিত ইরানের নারীদের নিত্যদিনের জীবন। বৈষম্যমূলক আইনের কারণে দিনদিন পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলছে দেশটিতে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ইরান সরকারের আক্রমণ থেকে বাদ পড়ছে না নারী, শিশু, মানবাধিকার কর্মী, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী, লেখক, সাংবাদিক ও দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে- এমন ব্যক্তিরা। নির্যাতন, নিপীড়ন, হয়রানি, বিচারবহির্ভূত আটক, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা, মৃত্যুদণ্ডসহ নানাভাবে ভোগান্তির শিকার এই বিপুলসংখ্যক মানুষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ