তুরস্ক সীমান্তে প্রবল ঠাণ্ডায় মধ্যে খোলা আকাশের নীচে ১২ অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। গ্রিসের সীমান্তঘেঁষা তুরস্কের এডির্না প্রদেশের ইপসালা গ্রামে শীতে জমে তাদের মৃত্যু হয় বলে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী সুলেমান সয়লু নিশ্চিত করেছেন। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
যদিও এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মৃত্যুর জন্য গ্রিস কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছে তুরস্ক। বুধবার তুর্কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীকে তুরস্ক সীমান্তের দিকে খালি পায়ে পাঠিয়েছিল গ্রিসের সীমান্তরক্ষীরা। তবে গ্রিস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গতকাল বুধবার সকালে নয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর আরও দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আরেকজন ঠান্ডায় অসুস্থ ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসা অবস্থায় তিনি মারা যান।
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সয়লু বলেন, গ্রিসের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ওই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আটকের পর তাদের পোশাক ও জুতা খুলে নেন।
তবে গ্রিসের অভিবাসন মন্ত্রী নটির মিটারাচি বলেন, এই মৃত্যুর ঘটনা বিয়োগান্তক। এ ছাড়া তুরস্কের বক্তব্যকে প্রপাগান্ডা বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। মন্ত্রী আরও বলেন, এই অভিবাসনপ্রত্যাশীরা সীমান্তে আসেননি।
আন্তর্জতিক আইন অনুসারে, কোনো অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ফিরিয়ে দিতে পারে না গ্রিস। তবে দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে গ্রিসের বিরুদ্ধে। যদিও গ্রিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে।
যদিও এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মৃত্যুর জন্য গ্রিস কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছে তুরস্ক। বুধবার তুর্কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীকে তুরস্ক সীমান্তের দিকে খালি পায়ে পাঠিয়েছিল গ্রিসের সীমান্তরক্ষীরা। তবে গ্রিস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে সাত বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। অবৈধভাবে তারা নৌকাযোগে লিবিয়া থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন।
শীতে তারা প্রাণ হারিয়েছিলেন। সর্বশেষ তুরস্ক ও গ্রিস সীমান্তে যারা মারা গেলেন তাদের মধ্যে কেউ বাংলাদেশের আছেন কি না, তা জানা যায়নি।
ভৌগোলিক ভাবে ইউরোপ আর এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন করেছে তুরস্ক। দেশটির এই অবস্থানগত সুবিধার কারণে এশিয়া, আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীরা স্থলপথে তুরস্ক হয়েই ইউরোপে ঢোকার পথ খোঁজেন। তবে বহু সময় মানব পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারান অনেকে।
বছর ছয়েক আগে এই তুরস্কের সৈকতে ভেসে এসেছিল তিন বছরের ছোট্ট শরণার্থী শিশু আয়লান কুর্দের দেহ। সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের নৌকাডুবি হয়ে মৃত্যু হয়েছিল তার। যুদ্ধদীর্ণ সিরিয়া-সহ মধ্য এশিয়ার শরণার্থী সঙ্কট প্রকট হয়ে পড়েছিল বিশ্বের দরবারে। সঙ্কট আজও মেটেনি। তুরস্কে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৭ লক্ষ সিরিয়ার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন। কিছু দিন আগে আমেরিকার সীমান্ত ঘেঁষা কানাডায় একই পরিবারের চার ভারতীয়ের দেহ উদ্ধার হয়েছিল। ঠান্ডায় জমে মৃত্যু হয়েছিল ওদের। অভিযোগ, বরফাবৃত সীমান্ত দিয়ে ওঁদের অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করছিল পাচারকারীরা।
প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয় দালালের হাত ধরে ইতালি ও স্পেন প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু। খবর আসে, আমেরিকায় যাওয়ার পথে বনে-জঙ্গলে দালালের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। ইউরোপে ঢোকার আশায় বলকানের বরফঢাকা জঙ্গলে হাজারো মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকার সংবাদও আসে।
ভালো পারিশ্রমিকের আশায় কয়েক বছর ধরে পাচারকারীদের সহায়তায় লিবিয়া যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সেখান থেকেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণ এ প্রবণতা বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া প্রতারণার শিকার হয়ে লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হাতে বহু বাংলাদেশি আছেন আটক অবস্থায়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ।
মানব পাচারের দিক থেকে আন্তজার্তিক সংস্থার তালিকাতে কেন বাংলাদেশ শীর্ষে? আমরা যদি এর কারণ খুঁজি তাহলে সর্বপ্রথম যে কারণটি আসবে তা হলো বেকারত্ব। দেশের বিপুল পরিমাণ বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ধারণা, বিদেশে গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। পারিবারিক সচ্ছলতা আসবে এই বিশ্বাস নিয়ে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় তারা। তাদের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিল করে পাচারকারীরা।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সূত্র মতে কক্সবাজার ও টেকনাফের ৮০টি পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচার হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্য জন্য মানব পাচার কমানো যাচ্ছে না। মানব পাচারকারী চক্রের সাথে পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হাত আছে বলে মনে করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানব পাচারের আরো একটি কারণ হলো অসচেতনতা। পাচার হওয়া ভিক্টিম যারা ফিরে আসে তাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা ভিক্টিমদের বক্তব্য, তাদের দুর্দশার কথাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের মাঝে তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। যে এলাকা থেকে মানব পাচার বেশি হচ্ছে সেই এলাকা চিহ্নিত করে সচেতন করা। বেকারত্ব কমাতে যুবক ও মহিলাদের কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধি করে নিজ দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে উন্নত দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়ানো। এছাড়া উপকূল ও সীমান্ত এলাকাতে পর্যাপ্ত কোস্ট গার্ড ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। সমুদ্রসীমা সুরক্ষার জন্য আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন দরকার বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, সমুদ্র পথে টহল বাড়াতে হবে। টেকনাফসহ সীমান্ত এলাকাগুলিতে ওয়াচ-টাওয়ার করে মানুষদের সার্বক্ষণিক চলাচল পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। মানব পাচারের এই চক্র ভেঙে দিতে রিসিভিং কান্ট্রির অনেক ভূমিকা পালন করতে হবে। এই বিষয়ে সরকারের আরো বেশি সচেতন হওয়া এবং সুনজর দেওয়া উচিত। এছাড়া জল, স্থল ও আকাশ পথে নজরদারি বাড়াতে হবে। ২১ শতক, সভ্য এক ধরণীতে দাস প্রথা বড়ই বেমানান। মানব পাচার জঘন্যতম একটি ব্যবসা। এটি নির্মূলের মাধ্যমে আমরা আধুনিক দাস প্রথা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ