সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংঘাতপ্রবণ এলাকার বাইরে সংবাদকর্মীদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। তবে ভারতের সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা ও মামলার ঘটনা অনেকটা নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
২০২১ সালে দেশটিতে ১২১ জন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে অন্তত ৬ সাংবাদিককে। ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নকারী সংস্থা রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস গ্রুপ (আরআরএজি) এ তথ্য জানিয়েছে।
আরআরএজি বুধবার প্রকাশ করেছে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ইন্ডিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট ২০২১’। এই প্রতিবেদনে ভারতজুড়ে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর নানামুখী আক্রমণের চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, গত বছর ভারতে ১০৮ জন সাংবাদিক ও ১৩টি সংবাদমাধ্যম আক্রমণের শিকার হয়েছে।
রাজ্যের বিবেচনায় সাংবাদিকদের অধিকারভঙ্গের এসব ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে জম্মু–কাশ্মীরে, ২৫টি। তালিকায় এরপরই রয়েছে উত্তর প্রদেশ ২৩টি, মধ্যপ্রদেশ ১৬টি, ত্রিপুরা ১৫টি, দিল্লি ৮টি, বিহার ৬টি, আসাম ৫টি। এ ছাড়া হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে ৪টি, গোয়া ও মনিপুরে ৩টি, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গে ২টি এবং অন্ধ্র প্রদেশ, ছত্তিশগড় ও কেরালায় ১টি করে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
গত বছর ভারতজুড়ে ১৭ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে আরআরএজি। তাদের মধ্যে নারী সাংবাদিক আটজন। সাংবাদিক গ্রেপ্তারেও এগিয়ে রয়েছে জম্মু–কাশ্মীর। ২০২১ সালে এখানে আটক হয়েছেন পাঁচজন সাংবাদিক। এ ছাড়া দিল্লিতে ৩ জন, মহারাষ্ট্র, মনিপুর ও ত্রিপুরায় ২ জন করে এবং আসাম, ছত্তিশগড় ও হরিয়ানায় ১ জন করে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জনসংখ্যা ও আয়তনের বিবেচনায় ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট একটি রাজ্য ত্রিপুরা। অথচ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় এই রাজ্য দেশটির বড় বড় রাজ্যগুলোর সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছে।
এ বিষয়ে আরআরএজির পরিচালক সুভাষ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ত্রিপুরা খুবই ছোট একটি রাজ্য। মহারাষ্ট্রের কোনো কোনো জেলায় চেয়েও এই রাজ্যের আয়তন কম। জনসংখ্যাও সীমিত। অথচ মহারাষ্ট্রের তুলনায় ত্রিপুরায় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ বেশি হয়েছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
এ বিষয়ে সুভাষ চাকমা আরও বলেন, ‘বিজেপি–শাসিত ত্রিপুরায় সংবাদমাধ্যমের ওপর যত আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, তেমনটা সাম্প্রতিক অতীতে আর দেখা যায়নি। এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
আরআরএজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও অভিযোগ গঠন করার প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইন।
সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করায় গত বছর বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আয়করসহ অন্যান্য সরকারি বিভাগের তদন্ত পরিচালনা করা হয়েছে। এ ছাড়া একই সময়ে অন্তত ৩৪ জন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম রাজনৈতিক দল, মাফিয়াদের মতো অসরকারি এককের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
২০২১ সালে দেশটিতে ১২১ জন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে অন্তত ৬ সাংবাদিককে।
ভারতে কয়েক বছর ধরেই সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা–মামলার ঘটনা বাড়ছে, এমন অভিযোগ করে আসছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের মতে, ভারতে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় ভারতে বিভিন্ন সময় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত এসেছে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ বলে যে গর্ব ভারত করতো, তা আজ মোদির ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি বেশ কিছু সূচকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান নিচে নেমে গিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবেই। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতে বিপন্ন হয়েছে গণতন্ত্র। প্রতিবাদ করলেই সরকারের রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিনা কারণে ইউএপিএ’র ধারা দিয়ে মানুষকে হেনস্থা করা হচ্ছে। এক প্রতিবেদনে এমনটিই দাবি করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্থা ‘সিভিকাস’।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিক থেকে ভারতকে ‘নিপীড়িত’ দেশগুলোর তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের উপর পুলিশের অত্যাচার, রাজনৈতিক নেতাদের চাপ সৃষ্টি, দুর্নীতিবাজ অফিসার ও অপরাধমূলক গোষ্ঠীর প্রতিশোধের হুমকি; সব মিলিয়ে ভারতের খর্ব হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা৷
দ্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের এক রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, হিন্দুবাদী সরকারের লাইনে থাকতে সংবাদমাধ্যমগুলির উপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে৷ যে সব সাংবাদিকরা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বা কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লিখছেন বা মুখ খুলছেন, তাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে চরম হেনস্থা, হুমকি দেওয়া হচ্ছে৷ বিশেষ করে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন নারী সাংবাদিকরা৷
এদিকে, ফ্রিডম হাউস বলছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নাগরিক স্বাধীনতার অবনতি হচ্ছে। তারা আরো বলেছে যে ‘মুক্ত রাষ্ট্রের উচ্চ কাতার থেকে ভারতের এই পতন’ বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
মোদির শাসনকালে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে ভারত এখন পাকিস্তানের মতই স্বৈরাচারী, এবং বাংলাদেশ ও নেপালের চাইতেও সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ। কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ায় এবং নাগরিক অধিকারের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ হওয়ায় ভারতের এই অবনতি হয়েছে। মোদির বিভিন্ন নীতিসমূহ ভারতে মুসলিম-বিরোধী অনুভূতি এবং ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিয়েছে, এবং তা ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দ্রুত কমছে। সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন রাখার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাকে সরকার ও কর্তৃপক্ষ ক্রমশ অগ্রাহ্য করছে। কেউ তাদের সমালোচনা করলেই হেনস্তা করা হচ্ছে। দেশদ্রোহের নামে সাংবাদিকদের জেলে পোরা হচ্ছে, অসংখ্য মামলার জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য এটা বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৩১
আপনার মতামত জানানঃ