ঠাকুরগাঁও সেনুয়া ইউনিয়নে হামলার শিকার তিন সাংবাদিককে এবার হাসপাতালে হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। জেলা আধুনিক সদর হাসপাতালের ৫০৩ নাম্বার কক্ষে ঢুকে রোববার বিকালে এক ছাত্রলীগ নেতা এই হুমকি দেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসাধীন সাংবাদিকরা।
তারা বলছেন, হুমকিদাতা ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম স্বরূপ কুমার সেন তন্ময়। তিনি রুহিয়া থানা শাখা ছাত্রলীগের সদস্য সচিব। তবে হুমকি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই ছাত্রলীগ নেতা। তার দাবি, আহত সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিতে গিয়ে তিনি উল্টো মারধরের শিকার হয়েছেন।
যা ঘটেছে
সদর উপজেলার সেনুয়া ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়ায় শনিবার হামলার শিকার হন নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি সোহেল রানা, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগো নিউজের ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানু, রাইজিং বিডির ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি হিমেল এবং দৈনিক উষার বাণীর জাহিদ হাসান মিলু।
আহত সোহেল রানা জানান, মণ্ডলপাড়ায় উঠান বৈঠককে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নোবেল কুমার সিংহ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোটরসাইকেল প্রতীকের আতাউর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সাংবাদিকরা সেই ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে নৌকার প্রার্থীর লোকজন তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন।
তিনি বলেন, ‘এরপর ১০-১২ জন তানু ও আমাকে বাঁশের লাঠি ও দেশি অস্ত্র দিয়ে মারধর করেন। হিমেল তাদের বাঁচাতে গেলে তাকেও মারা হয়। এ সময় আহত হন জাহিদ। ভাঙচুর করা হয় ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ক্যামেরা ও গাড়ি। পরে স্থানীয়রা তাদের ছাড়িয়ে আনেন।’
তবে সাংবাদিকের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌকার প্রার্থী। তার দাবি, হামলা করেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউরের সমর্থকরা। তবে আতাউর বলেছেন, অপপ্রচারে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী।
হামলায় আহত সাংবাদিকদের মধ্যে রানা, তানু ও হিমেলকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসাধীন তানু বলেন, ‘হাসপাতালের বেডে আমরা শুয়েছিলাম। এ সময় পরিবারে সদস্যসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ কক্ষে ঢুকে স্বরূপ বলেন, মামলা করলে পরিণতি ভালো হবে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে এরপর তিনজনের মরদেহও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
তিনি জানান, হুমকি দেয়ার পর তাকে ধরার চেষ্টা করে তার চাচাতো ভাই মাসুম রানাসহ অন্যরা। এ সময় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে পালিয়ে যান স্বরূপ।
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্য
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ নেতা স্বরূপ কুমার সেন বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগ নেতা রানাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আহত সাংবাদিকদের খোঁজ খবর নিতে যাই। এ সময় শনিবারের ঘটনা সামনে এনে আমাকে মারধর করা হয়। পরে সেখান থেকে চলে আসি।
পুরো বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিক বদিউল ইসলাম বিপ্লবের সামনে ঘটে বলেও জানান স্বরূপ।
বদিউল ইসলাম বলেন, আমি গিয়েছিলাম হামলার ওপর রিপোর্ট করতে। ওই ছাত্রলীগ নেতাসহ আরও একজন গিয়েছিল তাদের সংগঠনের আহত কর্মীদের দেখতে। আহত সাংবাদিকদের পাশের কক্ষেই তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
স্বরূপ সাংবাদিকদের কক্ষে গেলে তার সঙ্গে অন্যদের উচ্চবাচ্য হয়। এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে। হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো কথা আমি শুনিনি।’
ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি মুনসুর আলী বলেন, ‘যারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা করলো তারা এখনও ঘুরছে এবং তারা হাসপাতালে এসে সাংবাদিকদের হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে। এ সাহস কোথা থেকে আসে ছাত্রলীগের উশৃঙ্খল নেতাকর্মীদের।’
ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আটক করা না হলে আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে বলেও জানান এই সাংবাদিক নেতা।
ছাত্রলীগ নেতার হুমকির পর নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কথা জানিয়েছে আহত সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।
ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য হাসপাতালে পুলিশ ফোর্স পাঠানো হয়েছে।’
সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি
সাংবাদিক হত্যায় বিচার না হওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দশম। বলা হয় সাংবাদিকতা নাকি মহৎ পেশা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ২৩ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন; আহত হয়েছেন ৫৬১ জন (প্রথম আলো)। আরেকটি হিসাবে বলা হচ্ছে, ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
এত সাংবাদিক নিহত হলেন, অথচ বিচার শেষ হয়েছে মাত্র আটটির। এই আটটির বিচারিক রায়ের পাঁচটিই ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে জানিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস। তাহলে বিচার হলো কার? বিচার না পাওয়া ব্যক্তিদের দলে রয়েছে সাংবাদিক সাগর-রুনির সন্তান মেঘ। রক্ত হিম করা এই যুগল হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার তারিখ ৯ বছরে ৭৮ বারের মতো পেছাল।
সাংবাদিক হত্যার অনেক মামলার বিচারই শুরু হয়নি। কোনোটার চার্জশিট দেওয়া হয়নি। আবার কোনোটি নথিপত্রের অভাবে হারিয়ে গেছে। বেশির ভাগ মামলায় নথিপত্রের অভাবে অভিযুক্তরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলেও সেটাকে বাদ দিয়ে অন্য তিনটি স্তম্ভের ওপর রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার অপচেষ্টা চলছে। তিন পায়ে দাঁড় করিয়ে রাষ্ট্রকে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে।
সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপব্যবহার করে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। এরপর গণমাধ্যম কর্মী আইন নামে সাংবাদিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণের আরেকটি কালো আইন পাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ