কী করে উত্তর প্রদেশের জাট হৃদয় জেতা যায়, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখন সেই ভাবনায় দিনরাত এক করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। আসরে নেমে পড়েছেন রাজ্যের জাট নেতা প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও।
তাদের চোখে আপাতত শুধুই জাট–ভূমি বলে পরিচিত উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের প্রথম পর্বের ৫৮ ও দ্বিতীয় পর্বের ৫৩টি আসন। এই ১১৩টি আসনের ওপরেই নির্ভরশীল এবারের উত্তর প্রদেশ বিধানসভার ভোটভাগ্য। আর সে কারণে ধর্মীয় মেরুকরণের পথেই এবারও বিজেপি।
পাঁচ বছর আগে এই আসনগুলোতে বিজেপি কাউকে দাঁত ফোটাতে দেয়নি। বিশেষ করে প্রথম পর্বে যে কেন্দ্রগুলোতে এবার ভোট হতে চলেছে। গতবার এই ৫৮ আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৫৩টিতে।
সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ও বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) জিতেছিল ২টি করে আসন, ১টি পেয়েছিল রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি)।
এ অঞ্চলে বিজেপির ওই রমরমার কারণ ছিল ২০১৩ সালে মুজফফরনগরের ভয়াবহ দাঙ্গা। হিন্দু–মুসলমানের সেই দাঙ্গার কারণে বিস্তীর্ণ এই তল্লাটে যে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটে গিয়েছিল, তার ফল পেয়েছিল বিজেপি। ২০১৪ ও ২০১৯–এর লোকসভা এবং ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে জয়জয়কার তার প্রমাণ।
এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। কৃষক আন্দোলনে চাপা পড়ে গেছে ধর্মীয় ভেদাভেদ। হিন্দু–মুসলমান এক হয়ে জেগে উঠেছে এই তল্লাটের কৃষকসত্তা। সবচেয়ে বড় কথা, বিজেপির কাছ থেকে সরে গেছে জাট সমাজ অনেকটাই। সেই জাটরা, যারা প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী চরণ সিংয়ের অবদান ভুলে বিজেপিকে বরণ করে নিয়েছিলেন, এবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন।
সেই জাটদের মন জেতাই এখন বিজেপির বড় দায়। রাজনাথ সিং তাই পশ্চিম–উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় দলীয় সমাবেশে বলেছেন, চরণ সিং আদর্শ পুরুষ। জাটরা বিজেপির স্বাভাবিক শরিক। পরিবারের অংশ। ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছে হয়তো কিন্তু জাটেরা বিজেপি থেকে দূরে থাকতে পারে না।
ভোটের মুখে জাট মন জিততে ঝাঁপিয়েছেন অমিত শাহও। দুই দিন ধরে রাজ্যের জাট নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেছেন। ছক কষেছেন। সেই বৈঠকে তার এক বক্তৃতা ভাইরাল হয়েছে, যেখানে জাটদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সম্পর্ক সাড়ে ছয় শ বছরের। বৈঠকের পর অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন, বিজেপির বয়স তো পঞ্চাশও নয়! তা হলে? উত্তর হলো, আপনারা লড়াই করেছিলেন মোগলদের বিরুদ্ধে। আমরাও লড়ছি।’
এরই পাশাপাশি অমিত শাহ জাটদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ভেবে দেখুন, বিরোধী জোটের নেতা অখিলেশ হলেও নেতৃত্ব চলে যাবে বাহুবলি নেতা আজম খানের হাতে। সইতে পারবেন তো?’
এই বার্তার মধ্যেই স্পষ্ট, ধর্মীয় মেরুকরণের চেনা রাস্তাতেই নতুন করে হাঁটতে চাইছে বিজেপি। চাইছে সেই মেরুকরণের মধ্য দিয়ে জাট–মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করে ভোটে জেতা। এই কাজে প্রকাশ্যেই বিজেপি নেতৃত্ব টেনে আনছে মথুরায় কৃষ্ণ জন্মভূমির ‘মুক্তি’র বিষয়টি।
অমিত শাহ মথুরা–বৃন্দাবনে গিয়ে তার যে স্পষ্ট আভাস দিয়ে এসেছেন, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথসহ বিজেপির সবাই নির্বাচনী প্রচারে তা জানিয়ে বলছেন, অযোধ্যার মতো কৃষ্ণ জন্মভূমি উদ্ধার হবে ভোটে জেতার পর সরকারের নতুন কাজ।
প্রথম দুই পর্বে এই জাট ও ব্রজ ভূমিতে বিজেপির মূল চ্যালেঞ্জ এসপির সঙ্গে আরএলডির জোট। চরণ সিংয়ের নাতি অজিত সিংয়ের পুত্র জয়ন্ত চৌধুরী দীর্ঘদিন পরে জাট সমাজকে একজোট করতে পেরেছেন। পশ্চিম–উত্তর প্রদেশে মুসলমানরাও অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি। জাট ও মুসলমান জোটবদ্ধ হওয়ায় বিজেপির কাজ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেই কাজ সহজ করতে অমিত শাহ দলের জাট নেতাদের বৈঠকে বলেছেন, ‘জয়ন্ত চৌধুরীর মতো সুযোগ্য নেতা ভুল দলে রয়েছেন। এই ভুল শোধরানো দরকার। সেটা ভোটের আগে না হলেও পরে হতে পারে।’
স্পষ্টতই এটা জোট ভাঙার মরিয়া প্রচেষ্টাই শুধু নয়, নির্বাচন–পরবর্তী সরকার গঠনের টোপও বটে। তবে জয়ন্ত সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়েছেন, তিনি টাকার ‘কয়েন’ নন যে টুক করে পাল্টে যাবেন।
বিজেপি জাট মন জয়ের আপ্রাণ চেষ্টা চালালেও এখনো পর্যন্ত বহু জাট নেতা পশ্চিম–উত্তর প্রদেশে নিজেদের এলাকায় প্রচারে যেতে পারছেন না। একাধিক নেতাকে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে। কালো পতাকা দেখতে হয়েছে।
এই অবস্থায় ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েত জানিয়েছেন, বিজেপিকে ভোট দিলে সেটা হবে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। তিনি প্রথমে সরাসরি এসপি–আরএলডি জোটকে ভোট দেওয়ার কথা বললেও পরে সংযুক্ত কিষান মঞ্চের সিদ্ধান্তমতো বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাট–ভূমি বিজেপির প্রাথমিক চিন্তা হলেও দ্বিতীয় বড় মাথাব্যথার কারণ পূর্বাঞ্চলের অনগ্রসর ভোট। বিজেপি থেকে যে ১৪ জন অনগ্রসর নেতা বেরিয়ে এসপিতে যোগ দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই এ অঞ্চলের। সেই ক্ষতি পূরণে বিজেপিও ভাঙিয়েছে অখিলেশের পরিবার।
পাশাপাশি নজর দিয়েছে কংগ্রেসের অনগ্রসর নেতা আরপিএন সিংয়ের দিকে। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে অনগ্রসরদের।
কিন্তু জাতপাতের এই লড়াইকে ছাপিয়ে বিজেপি বড় করে তুলতে চাইছে উগ্র হিন্দুত্ববাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ। প্রচারে আধিক্য এই মেরুকরণেরই। প্রথম দফার ভোটের দুই সপ্তাহ আগে এখনো স্পষ্ট নয়, ধর্মীয় মেরুকরণ নাকি হিন্দু–মুসলমান কৃষক জোট প্রাধান্য পাবে, কোনটা?
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ