করোনার নতুন রূপ ওমিক্রনের প্রভাব এরই মধ্যে বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ওমিক্রন ঠেকাতে বিভিন্ন দেশে নেয়া হচ্ছে কঠোর ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। এরই মধ্যে করোনার আরও একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে শুরু হয়েছে জোর জল্পনা-কল্পনা। নিওকোভ নামে করোনাভাইরাসের নতুন এক ধরনের কথা জানিয়েছেন চীনের গবেষকরা। তাদের মতে, দক্ষিণ আফ্রিকার বাদুড়ের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়েছে।
উহানের গবেষকরা বলছেন, করোনার এই ধরনটি আরও পরিবর্তিত হয়ে ভবিষ্যতে মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
তাদের মতে, নিওকোভ করোনাভাইরাসের সব ধরনের চেয়ে বেশি সংক্রামক ও প্রাণঘাতী হতে পারে। এতে আক্রান্ত প্রতি ৩ জনে একজনের মৃত্যু হতে পারে। প্রচলিত কোনো টিকাই এটি প্রতিরোধে সক্ষম হবে না।
উহানের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণাপত্রের বরাত দিয়ে শুক্রবার ভারতের একাধিক সংবাদমাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে। সম্প্রতি বায়োআরজিভ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রটির এখনো পিয়ার রিভিউ করা হয়নি।
এতে উহান ইউনিভার্সিটি এবং চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট অব বায়োফিজিক্সের গবেষকরা বলেছেন, মানুষের কোষে নিওকোভের অনুপ্রবেশের জন্য শুধুমাত্র একটি মিউটেশন প্রয়োজন।
গবেষক দলটির ভাষ্য অনুযায়ী, নিওকোভ ধরনটি এখন পর্যন্ত মানুষকে আক্রান্ত করেনি। তবে এর আরও রূপান্তর ঘটলে তা মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তারা মনে করছেন, মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে ধরনটির আর একটিমাত্র রূপান্তর প্রয়োজন।
গবেষকেরা বলছেন, ২০১২ সালে সৌদি আরবে শনাক্ত হওয়া ভাইরাস মার্সের (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) সঙ্গে নতুন ধরনটি খুব সংশ্লিষ্ট। এটি মার্স কভের মতোই প্রাণঘাতী (প্রতি তিনজনে একজনের মৃত্যু) এবং বর্তমান করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরনের মতো উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন হতে পারে। চীনা গবেষকেরা আরও আশঙ্কা করেছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য বিদ্যমান অ্যান্টিবডি দিয়ে নিওকোভকে ঠেকানো যাবে না।
রুশ বার্তা সংস্থা তাসের এক প্রতিবেদনে নিওকোভ নিয়ে ডব্লিউএইচওর বক্তব্যকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। গতকাল সংস্থাটি বলেছে, গবেষণায় ভাইরাসের যে ধরন শনাক্ত হয়েছে, এটি মানবশরীরের জন্য হুমকি তৈরি করবে কি না, তা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ডব্লিউএইচও বলছে, যেসব ভাইরাস মানবদেহকে আক্রান্ত করে, তার ৭৫ শতাংশেরই উৎস বন্য প্রাণী। বাদুড়সহ বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস শনাক্ত হয়। এসব ভাইরাসের বেশির ভাগেরই প্রাকৃতিক ভান্ডার হিসেবে বাদুড়কে অভিহিত করা হয়।
ডব্লিউএইচও বলেছে, প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে তারা নিবিড়ভাবে কাজ করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগেই গবেষণার তথ্য দেওয়ায় চীনা গবেষকদের প্রতিও ধন্যবাদ জানিয়েছে সংস্থাটি।
শুক্রবার এক প্রতিবেদনে ভারতের সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, বিশ্বে প্রথম যে স্থানে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল,চীনের সেই উহান শহরের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এ বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী বায়োরিক্সিভে সম্প্রতি ছাপাও হয়েছে সেই প্রতিবেদন। তবে সেটির পিআর রিভিউ এখনও হয়নি।
গবেষণা প্রবন্ধে উহানের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে শনাক্ত হওয়া ভাইরাস মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (মার্স কোভ) ও করোনাভাইরাসের রূপান্তরিত ধরন বিটার সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে নতুন এই ভাইরাস নিউকোভের।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্স কোভ ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ২০১২ সালে। গৃহপালিত উট থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হওয়া এই ভাইরাসটি মূলত সার্স-কোভ-২ বা মূল করোনাভাইরাসের সমধর্মী একটি ভাইরাস। এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলেও কোভিডের মতো জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
মার্স কোভ ভাইরাসের সংক্রমণে ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিন বছরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
উহানের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ধারণা করা হচ্ছে- মের্স কোভ ও বিটার সংমিশ্রণে উদ্ভব ঘটেছে নিওকোভ ভাইরাসটির। এখন পর্যন্ত এটি কেবল বাদুড়ের দেহেই শনাক্ত হয়েছে, তবে কোভিডের মতো যদি বাদুড় থেকে মানবদেহে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে- সেক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় শুরু হবে বিশ্বজুড়ে।
নিওকোভ করোনাভাইরাসের সব ধরনের চেয়ে বেশি সংক্রামক ও প্রাণঘাতী হতে পারে। এতে আক্রান্ত প্রতি ৩ জনে একজনের মৃত্যু হতে পারে। প্রচলিত কোনো টিকাই এটি প্রতিরোধে সক্ষম হবে না।
এই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে গবেষণা প্রতিবেদনে তারা বলেন, প্রথমত এই নিওকোভ মূল করোনাভাইরাস ও ভাইরাসটির অন্যান্য রূপান্তরিত ধরনসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সংক্রামক বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তাছাড়া এই ভাইরাসটি অনেক বেশি প্রাণঘাতীও। মানবদেহে যদি এটির সংক্রমণ শুরু হয় সেক্ষেত্রে প্রতি ১০০ জন আক্রান্ত রোগীর ৩৫ জনেরই মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
লং কোভিডে হতে পারে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি
এদিকে যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, লং কোভিড (দীর্ঘস্থায়ী কোভিড) নীরবে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।খবর বিবিসি
একদল ব্রিটিশ গবেষক জেনন গ্যাস স্ক্যান পদ্ধতি ব্যবহার করে লং কোভিডে আক্রান্তদের ফুসফুসের সেসব লুকোনো ক্ষতি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, যা ফুসফুসের রুটিন স্ক্যানের মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
গবেষণার জন্য তারা এমন ১১জনকে বেছে নিয়েছিলেন, যাদের কোভিডে আক্রান্তের পর প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তবে, সংক্রমণের পর তারা দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগেছিলেন।
ছোট পরিসরে হওয়া এই গবেষণার ফলাফলগুলো নিশ্চিত হতে ও আরও বিস্তারিত জানতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা।
গবেষকরা বলছেন, লং কোভিডে আক্রান্ত বেশির লোকই কেনো শ্বাসকষ্টে ভোগেন, তা এই গবেষণার মাধ্যমে কিছুটা হলেও অনুধাবন সম্ভব হয়েছে। তবে শ্বাসকষ্টের আরও অনেক জটিল কারণ থাকতে পারে।
অক্সফোর্ড, শেফিল্ড, কার্ডিফ ও ম্যানচেস্টারের গবেষক দল গবেষণায় অংশ নেওয়া লোকেদের তিনটি দলে ভাগ করেছিলেন।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে লং কোভিডে আক্রান্ত একদল ব্যক্তি ছিলেন, শ্বাসকষ্ট হওয়ার পরেও যারা হাসপাতালে ভর্তি হননি; ১২ জন ছিলেন যারা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তবে তারা লং কোভিডে আক্রান্ত ছিলেন না এবং ১৩ জন ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তি।
এক অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে সমস্ত অংশগ্রহণকারী এমআরআই স্ক্যানিংয়ের সময় নিশ্বাসের সঙ্গে জেনন গ্যাস গ্রহণ করেন। গ্যাসটি শরীরের ভেতরে প্রবেশের পর অক্সিজেনের মতো আচরণ করলেও স্ক্যানের সময় এটি কম্পিউটার স্ক্রিনে দৃশ্যত হয়। আর এর মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা লং কোভিডে আক্রান্তদের ফুসফুসে লুকিয়ে থাকা ক্ষতি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
লং কোভিডে আক্রান্ত বেশিভাগ লোকের ক্ষেত্রেই গবেষকরা দেখেছেন, সুস্থ ব্যক্তির তুলনায় তাদের শরীরে গ্যাস চলাচল কম কার্যকর ছিল। এমনকি কোভিড নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও মোটামুটি একই রকম ফলাফল পেয়েছেন তারা।
প্রধান গবেষক ও ফুসফুস বিশেষজ্ঞ ডা. এমিলি ফ্রেজার বলেন, ক্লিনিকে আসা মানুষগুলো কেনো শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, তাদেরকে ঠিকভাবে তা ব্যাখ্যা করতে না পারাটা খুবই হতাশাজনক। অনেক সময় এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যানে এর কারণগুলো ধরা পড়ে না।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এবং আমি আশা করছি এটি আরও কার্যকর উপায়ে কারণগুলোর অনুসন্ধান করবে’।
গবেষকরা মনে করছেন, এ সংক্রান্ত বিস্তারিত গবেষণা লং কোভিডে আক্রান্তদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। হাজারও মানুষকে শাসকষ্টজনিত সমস্যা থেকে মুক্ত করার পথ মিলবে। সেইসঙ্গে লং কোভিডে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি থেকেও বাঁচার উপায় পাওয়া যাবে।
আরেক গবেষক অধ্যাপক ফার্গাস গ্লিসন বলেন, ‘লক্ষণগুলোর বিস্তারিত কারণ ও প্রক্রিয়াটি যখন আমরা ঠিকভাবে বুঝতে পারবো, কেবল তখনই আমরা এর কার্যকর চিকিত্সা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারবো’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৮
আপনার মতামত জানানঃ