দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের শ্রীফলতলা গ্রামে হাফেজিয়া মাদ্রাসার এক শিশু শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
নির্যাতনের শিকার ১১ বছর বয়সী সাব্বির শেখ শ্রীফলতলা গ্রামের মোহাম্মাদিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। তিন বছর ধরে সে ওই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। সহপাঠীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করায় গত রোববার তাকে শিক্ষক মেহেদী হাসান বেধম বেত্রাঘাত করেন বলে তার পরিবারের অভিযোগ।
রূপসার ঘাটভোগ ইউনিয়নের আনন্দনগর মেঝোঝিলার রউফ শেখ ও লিপি বেগমের সন্তান সাব্বির বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
নির্যাতনের ঘটনায় সোমবার সাব্বিরের মা লিপি বেগম বাদী হয়ে রূপসা থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগ মামলার এজাহার হিসেবে রেকর্ড করেছে পুলিশ।
লিপি বেগম বলেন, সহপাঠীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করায় তার ছেলেকে বেত দিয়ে পিটিয়েছে মেহেদী হুজুর; অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। একপর্যায়ে সাব্বির পালিয়ে তার গ্রামের বাড়ি আনন্দনগরে চলে আসে। গুরুতর জখম অবস্থায় তাকে রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত মাদ্রাসাশিক্ষকের উপযুক্ত শাস্তি চেয়েছেন সাব্বিরের মা।
মামলার বাদী ওই শিক্ষার্থীর মা লিপি বেগম মঙ্গলবার দুপুরে অনলাইনভিত্তিক এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সাব্বির রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছে। পুরো শরীর ফুলে উঠেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কিডনি পরীক্ষার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন। তার সুষ্ঠ চিকিৎসার জন্য আমরা চিন্তিত। এভাবে শারীরিক নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ওই শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
সাব্বিরের চাচা শেখ অসিকুর রহমান বলেন, ‘পড়া না করে দুষ্টুমি করায় নির্মমভাবে আমার ভাইপোকে বেত্রাঘাত করা হয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা সে অজ্ঞান ছিল। শরীরের পিঠে ও হাতের বাহুতে মোট ৪০টি বেত্রাঘাত রয়েছে। প্রতিটি আঘাতের স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে।’
রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. শফিক জানান, বেত্রাঘাতের কারণে আগাতের স্থানগুলোতে কালো রক্ত জমাট বেঁধেছে। সাব্বিরের হাত ও মুখ ফুলে গেছে। এ কারণে তার কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাকে সুস্থ করে তুলতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।
ঘটনার পর থেকে শিক্ষক মেহেদী পলাতক। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মোবাইলটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
রূপসা থানার অফিসার ইনচার্জ সরদার মোশাররফ হোসেন জানান, মাদ্রাসাছাত্রকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করার অভিযোগ করেছেন শিশুটির মা। এ বিষয়ে মামলা প্রক্রিয়াধীন।
সহপাঠীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করায় তার ছেলেকে বেত দিয়ে পিটিয়েছে মেহেদী হুজুর; অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। একপর্যায়ে সাব্বির পালিয়ে তার গ্রামের বাড়ি আনন্দনগরে চলে আসে। গুরুতর জখম অবস্থায় তাকে রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
দেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা নতুন নয়। প্রায়শ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ ওঠে।
শিশু শিক্ষার্থীদের উপর মাদ্রাসা শিক্ষকদের চালানো নির্মম নির্যাতনের একাধিক ভিডিও ফেসবুকে ভাইরালও হয়েছে। একাধিক শিক্ষককে কারাগারেও পাঠিয়েছে আদালত।
গত বছরের মার্চে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় একটি মাদ্রাসায় এক শিশুকে বেদম পিটুনির ভিডিও ভাইরাল হয়। পরে ওই শিক্ষককে আটক করা হয়। এর পরপরই সাতকানিয়ার একটি মাদ্রাসায় চার শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এই ঘটনায় নাম আসা শিক্ষকেও কারাগারে পাঠানো হয়। গত ১০ আগস্ট ঝালকাঠি সদর উপজেলার একটি মাদ্রাসায় ১০ ছাত্রকে বেত্রাঘাত করেন এক শিক্ষক।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে সারাদেশে এক হাজার ৭৪১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২৫টি শিশু৷ এইসব ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে মাত্র আটটি৷ এই সময়ে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪ জন শিক্ষার্থী৷ ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে৷
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷
শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, মাদ্রাসাগুলোতে প্রায়ই মারধর ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আর এদের বেশির ভাগই সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে আসা। সাধারণ শিক্ষার ব্যয় বহন করতে না পেরে অনেক অভিভাবকই সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে থাকেন। আবার ধর্মীয় চেতনা থেকেও শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। তাই সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করার আগেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ