সব দেশেই এখন বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। যার থেকে বাদ পড়ছে না মুসলিমপ্রধান দেশগুলোও। সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে সৌদি আরবে।
দেশটিতে প্রতি ঘণ্টায় সাতটি করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। সৌদির জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের বরাত দিয়ে সোমবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আমিরাতভিত্তিক দৈনিক গালফ নিউজ।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে পরিসংখ্যান দফতর জানিয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সৌদি আরবে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়েছিল ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। পরবর্তী বছর ২০২১ সাল থেকে এই হার আরও বেড়েছে।
২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সৌদিতে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়েছে মোট সংখ্যা ৫৭ হাজার ৫০০টিরও বেশি এবং গত প্রায় দুই বছরের প্রতি মাসেই জমা পড়া আবেদনের সংখ্যা ছিল আগের মাসের চেয়ে বেশি।
গালফ নিউজকে এক সৌদি কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে সৌদি আরবে প্রতি ঘণ্টায় ৭টি ডিভোর্স হচ্ছে। দশমিক হিসেবে বলা যায়, দেশটিতে প্রতি ১০টি বিয়ের ৩টিই ভেঙে গেছে গত প্রায় দু’ বছরে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ১০ বছর আগে ২০১১ সাল থেকেই দেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সালের গোটা বছর যেখানে সৌদি আরবে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল ৯ হাজার ২৩৩টি, সেখানে তার পরের বছরেই এই সংখ্যা বেড়ে পৌঁছায় প্রায় ৩৪ হাজারে। অর্থাৎ শতকরা হিসেবে, ২০২০ থেকে ২০২১- মাত্র এক বছরে সৌদিতে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছিল ৬০ শতাংশ।
দেশটিতে প্রতি ঘণ্টায় সাতটি করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সৌদি আরবে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। দেশটির পরিবারবিষয়ক পরামর্শক মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ আল-কুরানি জানান, বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিয়ের অবমূল্যায়ন, সত্যিকার সম্পর্ক ও দায়িত্বের প্রতি অবহেলা এবং রাতে দেরি করে স্বামীর ঘরে ফেরা।
আল-কুরানি বলেন, যেসব নারী বাইরে চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করে, ধীরে ধীরে তারা ঘরে সময় দেয়া কমিয়ে দেয়। বাইরে থেকে যখন ঘরে ফেরে, তখন পরিবার, স্বামী ও সন্তানের পেছনে সময় ব্যয় না করে মোবাইলে সময় নষ্ট করে। যার কারণে তাদের দাম্পত্য জীবন নষ্ট হয়ে যায়। একপর্যায়ে বিবাহ বিচ্ছেদের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডের পর দেশে ‘মানবিক বিয়ে’ নামে নতুন এক শব্দযুগলের আবির্ভাব ঘটে, যেটা প্রচলিত ইংরেজি শব্দে ‘লিভ ইন’ কিংবা ‘লিভ টুগেদার’ হিসাবেও বিবেচিত হয়। মামুনুল হকের পর হেফাজতের আরও কয়েক নেতার বিরুদ্ধেও এই মানবিক বিয়ের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইসলাম ধর্মের তীর্থভূমি সৌদি আরবেও এই মানবিক বিয়ের ছড়াছড়ি দেখা গেছে।
সৌদিআরবে ক্রমেই চুক্তি ভিত্তিক নামমাত্র বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে। শর্তহীন এই বিয়ে সৌদি সমাজে ‘মিসইয়ার’ নামে পরিচিত। তবে এই বিয়ে নিয়ে চিন্তিত সৌদির ‘ধর্মীয়’ ব্যক্তিরা। তাদের অভিযোগ ‘মিসইয়ার’-এর মাধ্যমে আদতে উচ্ছৃঙ্খলতাকেই বৈধতা দান করা হচ্ছে।
জানা যায়, মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী বিয়ের আগে সহবাস অবৈধ। তবে এই মিসইয়ারের আড়ালে সৌদি ব্যক্তিরা ‘লিভ-ইন’ বা পরকীয়ায় মেতেছেন। এর জন্যে বিশেষ ‘ম্যাচ-মেকিং’ সাইট বা গ্রুপও আছে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
সৌদিআরবে বন্ধনহীন চুক্তি-বিয়ে (মিসইয়ার) বাড়ছে। ‘জাওয়াজ আল মিসইয়ার’ নামে পরিচিত এ বিয়েকে ‘ভ্রমণকারীদের বিয়ে’ও বলা হয়।
স্থানীয় সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে এ বিয়ে প্রচলিত রয়েছে। কোনোরকম আত্মিক বন্ধন ছাড়া এ বিয়ের চুক্তি অনুযায়ী তারা একসঙ্গে থাকতে পারবে।
এর শর্ত অনুযায়ী স্ত্রীর আবাস সংস্থান ও অর্থ ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকবেন স্বামী। বিনিময়ে গৃহ রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার ঘরে ঢোকার অনুমতি পাবেন স্বামী। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিয়ের বৈধতা দেওয়ার জন্য কয়েকটি মুসলিম দেশে চাপ বাড়ছে।
মিসইয়ার বিয়ের শর্তের মধ্যে আরও রয়েছে উভয়ের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে নগদ অর্থ। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে এর মেয়াদ। তবে যেকোনো সময়ে উভয়পক্ষ মুসলিম বিয়ের মূল রীতি অনুযায়ী বিয়ে করতে পারবেন। আবার যেকোনো সময় একে অন্যকে ছেড়ে যেতে পারবেন। লোকলজ্জার ভয়ে সাধারণত এ বিয়ের কথা গোপন রাখা হয়।
জানা যায়, মিসইয়ার প্রকৃতপক্ষে বৈবাহিক সম্পর্ক ও একাকী জীবনের একটা মিশ্রণ। যেখানে বহুগামী নারী-পুরুষ দ্বিতীয় সংসার বয়ে বেড়ানোর চাপ এড়িয়ে বৈবাহিক সম্পর্কের সুবিধা উপভোগ করে থাকেন।
স্থানীয় নাগরিকদের মতো সৌদি আরবে বসবাসকারী প্রবাসী কর্মীরাও এ ধরনের বিয়েতে ঝুঁকছেন বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। নিজেদের পার্টনার খুঁজতে অনলাইনে বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপ ও বিয়ের ঘটকালিতে নিয়োজিত ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হচ্ছেন তারা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন বিয়েতে নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকি আছে। তারপরও কিছু নারীর কাছে এই পদ্ধতি পুরুষতান্ত্রিক প্রচলিত বিবাহব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা উপায়। আবার অবিবাহিত দম্পতিরা একে নিজেদের যৌন চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে একধরনের বৈধতার আবরণ হিসেবে বিবেচনা করেন। যদিও ইসলামে বিবাহবহির্ভূত যেকোনো শারীরিক সম্পর্কই নিষিদ্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ