সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার ঘটনার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিন্দার ঝড় বইছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।
ঘটনার সূত্রপাত
বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হল প্রভোস্ট বডির পদত্যাগসহ তিন দফা দাবি ও অবস্থান কর্মসূচিতে হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। রোববার (১৬ জানুয়ারি) চতুর্থ দিনের মতো আন্দোলন করছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে বিকেলের পর থেকে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে ক্যাম্পাস।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, দাবি আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা ভবনের কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, শিক্ষক সমিতির নেতা, প্রক্টরিয়াল বডি ও কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের তালা খুলে দিতে বলেন। শিক্ষার্থীরা এতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বাগবিতণ্ডা হয়।
এসময় কোষাধ্যক্ষ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করে বলেন, ভেতরে অবরুদ্ধ থাকায় উপাচার্য অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে। তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এসময় শিক্ষার্থীদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করলে পুলিশের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাটিচার্জ শুরু করলে শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। প্রায় ২৫ মিনিট উভয় পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। পরে শিক্ষার্থীরা সরে গেলে তালা ভেঙে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর উপাচার্যকে উদ্ধার করে পুলিশ তার বাসভবনে নিয়ে যায়। এরপর আধাঘণ্টা পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা জানান, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে কার্যালয়ের সামনে দেখা মাত্র দৌড়ে এসে তাকে ঘিরে ফেলেন। তারা উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন। এসময় উপাচার্যের সঙ্গে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তারা লাঞ্ছিত হন। প্রায় পাঁচ মিনিট উভয় পক্ষে ধাক্কাধাক্কি হয়। এসময় শিক্ষক-কর্মকর্তারা মানবপ্রাচীর তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইসিটি ভবনে নিয়ে যান উপাচার্যকে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি, উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাকে দেখে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য স্লোগান দিয়ে পথ অবরোধ করেছিলেন।
এর আগে বিকেল পৌনে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাস, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মহিবুল আলম, বিভিন্ন বিভাগের প্রধান, ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমেদ, প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. আলমগীর কবিরসহ অন্যান্য শিক্ষকরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। তারা শিক্ষার্থীদের বলেন, উপাচার্য দাবি মেনে নিয়েছেন, বাস্তবায়নে এক সপ্তাহ সময় চান। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এ কথা প্রত্যাখ্যান করে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেন। এক পর্যায়ে ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে তারা অবরুদ্ধ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক সমিতির সভাপতি শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দিয়ে হলের গুণগত মান উন্নত এবং অব্যবস্থাপনার সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান। এজন্য তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে সাত দিনের সময় চান। কিন্তু শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবি না মানার প্রেক্ষিতে তারা বর্ধিত সময় দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন এবং তখন শিক্ষার্থীরা তাদের সামনে ধিক্কার ধিক্কার, প্রশাসন ধিক্কার বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
এরপরে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের পিছু নেন এবং অর্জুন তলা থেকে ফিরে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে গেলে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনকে সামনে পান। তখন শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পিছু নিয়ে ধিক্কার ধিক্কার স্লোগান দিতে থাকে। এসময় উপাচার্যকে নিয়ে উপস্থিত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইসিটি ভবনে ঢুকলে শিক্ষার্থীরা সেখানে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন।
উপাচার্যকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা শিক্ষার্থীদের
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ সোমবার বেলা সোয়া একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি জানানো হয়।
যে সমস্ত শিক্ষক ছাত্রদের শরীর থেকে রক্ত ঝরানোর নির্দেশ দেন, তারা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আছি।’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের নিয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কোনো চিন্তা নেই। এ কারণেই তিনি ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এনেছেন এবং সেই পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তারা শিক্ষার্থীবান্ধব নতুন উপাচার্য চান।
এর আগে আজ সোমবার সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের সামনে ২০ থেকে ২৫ শিক্ষার্থীকে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। এ সময় তারা হল ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দেন। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে পুলিশি হামলার ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। সকাল সোয়া নয়টার দিকে ওই শিক্ষার্থীরা হলের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ক্যাম্পাসের ভেতরের বিভিন্ন রাস্তায় স্লোগান দিতে থাকে। ধীরে ধীরে ওই মিছিলের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও জড়ো হন। এখন কয়েক শ শিক্ষার্থী গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান দিচ্ছেন।
বেলা দুইটা থেকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শুরু করে এখানে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণস্বাক্ষর নেওয়া শুরু করেছেন। বেলা সোয়া দুইটার দিকে শিক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন।
১৬ তারিখের কিছু ফুটেজ
হামলার ঘটনা খতিয়ে দেখতে কমিটি
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আট সদস্যের কমিটির প্রধান গণিত বিভাগের অধ্যাপক ডা. রাশেদ তালুকদার। দ্রুত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আলমগীর কবির বলেন, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক রাশেদ তালুকদারকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। সদস্যসচিব হিসেবে রাখা হয়েছে রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেনকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি তুলসী কুমার দাস, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন আরিফুল ইসলাম, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড মিনারেল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন রুমেল আহমদ, লাইফ সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. কামরুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন মো. খায়রুল ইসলাম এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন দিলারা রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষদের পদত্যাগ, হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত এবং ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। রোববার উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার পাশাপাশি লাঠিপেটা করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে উপাচার্যকে মুক্ত করে। গতকাল রাতে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা করেন এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বলেন। এরপর শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন।
ফেসবুকে নিন্দার ঝড়
শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার ঘটনার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিন্দার ঝড় বইছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।
সিলেটের শিল্পী ও সংগঠক অরূপ বাউল ‘রক্তাক্ত সাস্ট’ নামে একটি ই-পোস্টার তৈরি করে তার ফেসবুকে পোস্ট করেন। পরে অসংখ্য মানুষ এটি শেয়ার দিয়েছেন। ই-পোস্টার পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘যে সমস্ত শিক্ষক ছাত্রদের শরীর থেকে রক্ত ঝরানোর নির্দেশ দেন, তারা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আছি।’ প্রসঙ্গত, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে ইংরেজিতে সংক্ষেপে এসইউএসটি বা সাস্ট বলা হয়।
আরমান মুন্না নামের সিলেটের একজন একটি বিক্ষোভ মিছিলের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘শাবিপ্রবি রক্তাক্ত! রক্তে রক্তে আরও লাল হয়ে ওঠে বুকের কৃষ্ণচূড়া। অন্যায় রুখে দাও।’ সিলেটের সংস্কৃতিকর্মী মামুন পারভেজ ই-পোস্টার ‘রক্তাক্ত সাস্ট’ পোস্ট করে লিখেছেন, ‘শব্দবোমা দিয়ে কি কণ্ঠ রোধ করা যায়?’
বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। উপাচার্যের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে পুলিশ প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই উপাচার্যের অনুমতি নিয়েই পুলিশ ক্যাম্পাসে গিয়েছে। আর যেভাবে পুলিশ শিক্ষার্থীদের মারধর করেছে, সেটা কোনো অবস্থাতেই ঠিক হয়নি। যদি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন, তাহলে এটা তাঁরা সামলাতে পারতেন। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটত না। এ ছাড়া শনিবার সন্ধ্যায় ছাত্রীদের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলার বিষয়েও আমরা নিন্দা জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রক্টরের চোখের সামনে এসব ঘটলেও তাঁরা হামলার বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে অস্বীকার করছেন। এতে আন্দোলনরত ছাত্রীদের মনে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৯
আপনার মতামত জানানঃ