ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ধাপে ধাপে সহিংসতা বেড়েই চলেছে। নির্বাচনি সহিংসতার কারণে বাড়ছে নিহত ও আহতের সংখ্যাও। ইতোমধ্যে নিহতের সংখ্যা শতক ছাড়িয়েছে। এই নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞরাই।
গত শনিবার (৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত সহিংসতায় মারা গেছেন অন্তত ১০৫ জন। ওই দিন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রতিপক্ষের হামলায় আহত জামাল শেখ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থায় মারা যান।
রক্তাক্ত নির্বাচন
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ভাষ্যানুযায়ী, সহিংসতার বিচারে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনি এই সহিংস ঘটনার কারণে খোদ একজন নির্বাচন কমিশনার চলমান ইউপি নির্বাচনকে ‘রক্তাক্ত নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহিংসতার দায় ভোটার ও প্রার্থীদের ওপর চাপিয়েছেন। আট ধাপে অনুষ্ঠেয় চলমান ইউপি নির্বাচনের পঞ্চম ধাপ-পরবর্তী সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি তিন ধাপে এই সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর প্রথম দুই মাসে ছোটখাটো কয়েকটি সংহিস ঘটনা ঘটলেও কেউ মারা যায়নি। তবে গত বছরের মার্চ মাসে মারা যায় ১০ জন। পরে জুনে সেই সংখ্যা বেড়ে ১৫ জনে দাঁড়ায়। সেপ্টেম্বর মাসে গিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১ জনে।
সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে নভেম্বর মাসে। ওই মাসে নতুন করে ৫৬ জন-সহ ১১ মাসে মোট নিহত হয় ৮৭ জন। ডিসেম্বরে নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত হয়েছে ২৬ জন। সব মিলিয়ে আসকের প্রতিবেদন মতে, গত বছর ইউপি নির্বাচনি সহিংসতায় মারা গেছে ১১৩ জন।
এ সময়ে ৬৭২টি সহিংস ঘটনায় সাত হাজার ২০১ জন আহত হয়। আসকের এই প্রতিবেদন তৈরির পরবর্তী সময়ে আরও ১৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চম ধাপের ভোটের দিনই নিহত হয় ১১ জন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৪টিতেই প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বোচ্চ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাত জন নিহত হয়েছে কক্সবাজারে।
আর পাঁচ জন করে মারা গেছে মাগুরা, পাবনা ও বগুড়ায়। ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও ও গাইবান্ধায় মারা গেছে চার জন করে। তিন জন করে নিহত হয়েছে যশোর, পটুয়াখালী, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা ও চাঁদপুরে। দু’জন করে নিহত হয় ভোলা, টাঙ্গাইল, মেহেরপুর, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, লক্ষ্মীপুর, মাদারীপুর, নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ (রূপগঞ্জ) ও সিরাজগঞ্জে।
এ ছাড়া একজন করে নিহত হয়েছে ঝালকাঠি, বাগেরহাট, ফরিদপুর, হবিগঞ্জ, নড়াইল, রাঙামাটি, মৌলভীবাজার, রংপুর, পিরোজপুর, কুড়িগ্রাম, খুলনা, নীলফামারী, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জে।
চলমান ইউপি নির্বাচনের আরও তিনটি ধাপ বাকি রয়েছে। আগামী ৩১ জানুয়ারি ষষ্ঠ ধাপে ২১৯টি, ৭ ফেব্রুয়ারি সপ্তম ধাপে ১৩৮টি এবং ১০ ফেব্রুয়ারি অষ্টম ধাপে ৮টি ইউপির ভোট হবে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা— এসব নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানি আরও বাড়ার আশঙ্কা দূর করার মতো পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশন এখনও প্রস্তুত করতে পারেনি।
ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার ইতিহাস
আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় সহিংসতায় ১৪৭ জন মারা যায়। ওই সময় ৭১১টি সংহিস ঘটনা ঘটেছিল, যাতে ৯ হাজার ৩৮৭ জন আহত হয়।
আসকের প্রতিবেদন বলছে, গত দুই মাসে যে সহিংস ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০১৬ সালের সহিংসতার পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মতে, ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী সংঘর্ষ এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে ১৪৫ জন নিহত হয়। তখন আহতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে অতীতের নির্বাচন পর্যালোচনা করে ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩ ও ১৯৯২ সালের ইউপি নির্বাচনে কোনও প্রাণহানির তথ্য পাওয়া যায়নি। ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রাণহানির রেকর্ড ছিল এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৮ সালে। ওই সময় ৮০ জন নিহত হয় বলে জানা গেছে।
দেশের ইতিহাসে এর আগে এই নির্বাচনটাই সব থেকে ‘খারাপ’ নির্বাচন হিসেবে পরিচিত ছিল। এছাড়া ১৯৯৭ সালে ৩১ জন, ২০০৩ সালে ২৩ জন এবং ২০১১ সালে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে।
আসক ও সুজনের প্রতিবেদন ছাড়াও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যালোচনা করে সহিংসতা বন্ধে প্রথম দিকে নির্বাচন কমিশনকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা না গেলেও ধাপে ধাপে নিহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
এ কারণে সহিংস এলাকা পরিদর্শনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন। তবে, ইসির এসব পদক্ষেপ কোনও কাজে আসেনি। বরং ধাপে ধাপে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিসংতার পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে হামলা,পাল্টা-হামলা আর গোলাগুলি নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনের খুনখারাবি জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। দেশের মানুষ রক্তাক্ত নির্বাচন দেখতে চায় না।’
ইউপি নির্বাচনে চলমান সহিংসতার উদ্বেগ প্রকাশ করে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে কমিশনার মাহবুব তালুকদার এবারের ইউপি নির্বাচনকে ‘রক্তাক্ত নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত করেন।
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস ও সংঘর্ষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এখন ভোটযুদ্ধে যুদ্ধ আছে, ভোট নেই। ইউপি নির্বাচনে বিষাদের করুণ সুর বাজছে। কিন্তু নির্বাচন ও সন্ত্রাস একসঙ্গে চলতে পারে না। জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়— এই বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে পৌঁছাতে সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছি।’
অবশ্য গত ৬ জানুয়ারি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ইউপি নির্বাচন নিয়ে কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যকে মিথ্যাচার বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনও এজেন্ডা বাস্তবায়নে জন্য ইসি নিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত কথা বলছেন।’
ওই সময় সিইসি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ও মৃত্যুর দায় নির্বাচন কমিশনের নয় বলে দাবি করে সহিংসতার দায় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ওপর চাপিয়ে দেন।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনে সহিংসতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অতীতে দেখেছি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমরা এখন দেখছি বিষাদের নির্বাচন। ২০১৬ সালেও আমরা সহিংসতা দেখেছি। কিন্তু এবারের মাত্রাটা ভিন্ন।
আর ব্যতিক্রমী হচ্ছে— এবারের সহিংসতাটা ঘটছে ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যে। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে।
সহিংসতাকে রোগের লক্ষণের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘রোগটি হচ্ছে ক্ষমতা, প্রভাব ও শক্তি ব্যবহার করে যেকোনোভাবে জয়ী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ